ঢাকা: সোনা চোরাচালানের সঙ্গে দেশের স্বর্ণ তথা জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কখনোই চোরাই স্বর্ণের চালানসহ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা আটক হননি।
এদিকে চোরাচালান রোধে সীমান্তে কড়া নজরদারিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া, অন্যান্য মামলার রহস্য উদঘাটনের মতো আটক চোরাকারবারিদের পেছনে কারা আছে, তাদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি, বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রি হলে বাজুস ফেয়ারের দ্বিতীয় দিনে আয়োজিত এক সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন। সোনা চোরাচালান বন্ধে করণীয়- শীর্ষক সেমিনারটির আয়োজন করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)।
বাজুসের সহ-সভাপতি রিপনুল হাসান বলেন, যে স্মাগলিং করছে, সে সোনা নিয়ে আসছে শর্ট টাইমে। আর আমার বৈধভাবে সোনা আনতে সময় লাগছে ১৫ দিন। আমাকে সে সুবিধাটা করে দিন, দেখুন চোরাকারবারি থাকে কি না। খুনসহ অন্যান্য মামলার রহস্য উদঘাটন করা হয়, ঘটনার পেছনের গডফাদারদের বের করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত যত চোরাকারবারি ধরা পড়ছে, তার পেছনে কে আছে, তা কেউ বের করছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারা আছেন, আপনারা বের করে দেখুন তারা কেউ বাজুসের সদস্য নয়।
বাজুসের সাবেক সভাপতি দীলিপ কুমার রায় বলেন, চোরাচালানে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের জড়িত থাকার অপবাদ নিয়ে আমরা যুগের পর যুগ ভুগছি। যুগের পর যুগ ধরে চলা এ দায় থেকে আমরা মুক্তি চাই। পার্শ্ববর্তী দেশসহ অনেক দেশ আছে, যাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণ বিক্রি করে। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা চালু হোক, আমরা চালান জমা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বর্ণ কিনব। বসুন্ধরা গ্রুপ গোল্ড রিফাইনারি চালু করছে, আমরা তাদের কাছ থেকে সাপ্লাই পেলেও চোরাকারবারি থাকবে না।
যে দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা যত দুর্বল, সে দেশে চোরাকারবারিদের রুট ততো বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বর্ডার সিল করতে পারলে, বাংলাদেশ হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে যে পরিমাণ স্বর্ণ যায়, প্রতি বছর সেসব আটকাতে পারলে সোনা দিয়ে পদ্মা সেতুর পিলারের মতো এক একটা পিলার বানানো সম্ভব। এ ছাড়া যে পরিমাণ স্বর্ণ আটক হয়, সে পরিমাণ ব্যাংকে জমা পড়েনা। দেখা যায়, ১০০ ভরি আটক হয়, আর জমা হয় ২৫ ভরি। আবার দেখা যায় ২৪ ক্যারেটের সোনা ধরা পড়ছে, কিন্তু আমরা নিলামে কিনতে গেলে পাই ১৪-১৫ ক্যারেটের।
বাজুসের কোষাধ্যক্ষ উত্তম বণিক বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে কোনো ব্যবসায়ী জড়িত নন। যদি কোনো ব্যবসায়ীর জড়িত থাকার খবর বাজুস জানে, তাহলে তাকে বাজুস থেকে বহিষ্কার করে আইনের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু এ পর্যন্ত চোরাচালানে আটক একজনের সঙ্গে কি ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা আছে? চোরাচালান বন্ধ আমাদের করার কথা নয়। কারণ আমরা চোরাচালান করি না। কারা করছে সেটা খুঁজবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বাজুস যশোর জেলার প্রতিনিধি সঞ্জয় বলেন, আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর আসার পর অনেক ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে। পণ্য এখানে উৎপাদন হলে এমনিতেই চোরাচালান বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার স্বর্ণ আমদানিতে ভ্যাট কমিয়ে দিক, ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট সহজ করুক, চোরাচালান এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।
বাজুসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আলী হোসেন বলেন, সোনা প্রাচীন শিল্প। কিন্তু আমরা ভয়ে ভয়ে ব্যবসা করি। কখন যেন কী হয়, আতঙ্ক কাজ করে আমাদের মধ্যে। সমস্যা সমাধানে যার কাছে যখনই যাই, তারা বলেন আপনারা প্রপোজাল নিয়ে আসুন, সবকিছু করে দেবো। কিন্তু আমরা কারো কাছে যেতে পারছি না। আমার মনে হয় এ শিল্পের বিকাশে সরকারের আলাদা একটি উইং দরকার, যারা স্বর্ণ নিয়ে ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে।
বাজুসের সাবেক সভাপতি আমিন জুয়েলার্সের কর্ণধার কাজী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডিমান্ড সাপ্লাই যদি ঠিক করা যায়, তাহলে চোরাচালান কমবে। কিন্তু চোরাচালানের ৯৯ ভাগ সোনাই পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যায়, কারণ আমাদের বর্ডার একদম আলগা। চোরাচালানের একটি গ্রুপই আছে আলাদা। এর সঙ্গে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের কোনো সম্পর্কই নেই।
ডিআরইউর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন, যেকোনো খাতের সমস্যা সমাধান করতে তথ্য লাগবে। আমি মনে করি একটি গবেষণা হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে দেশে সোনার চাহিদা, ব্যবহার ও উৎস সম্পর্কে একটি চিত্র উঠে আসবে। আর বাজুসের উচিত কাজটি করা।
চোরাচালান বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা চোরাচালান বন্ধ করতে চাই কি চাই না। রাষ্ট্র চাইলে কোনোভাবেই চোরাচালান থাকবে না। চোরাচালানের রুট চিহ্নিত করে সিল করতে পারলে আর সোনা বহনকারীকে ধরতে পারলে, তার পেছনে থাকা ব্যক্তিদের বের করতে পারলে সমাধান হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বিমানবন্দরের কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত যদি না থাকে, সোনা চোরাচালানের বিশাল যে ক্ষেত্র তৈরি হতো না। চোরাচালানের এসব সোনার গন্তব্য কোথায়, কোথা থেকে আসে, এসব বের করা দরকার। এ ছাড়া, সোনা বৈধ পথে আনাকে উৎসাহিত করতে হবে। চাহিদা বন্ধ হলে চোরাকারবারিরা নিরুৎসাহিত হবে। আমদানি নীতিমালা সহজ করতে হবে। আমাদের বহু আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগে বড় সমস্যা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে চোরাচালান রোধ সম্ভব।
সেমিনারে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন হোছাইনী বলেন, স্বর্ণ শিল্পের বিকাশে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অন্তরায় চোরাচালান। বাংলাদেশে ২০৩০ সালে সোনার মার্কেট ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। স্থানীয় বাজারে ১০ শতাংশ স্বর্ণের যোগান আসে পুরাতন স্বর্ণ থেকে। আর ৯০ ভাগই অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম ব্যাগেজ রুলের আওতায়, আর বাকি চোরাচালানের মাধ্যমে। বেসরকারি গবেষণা বলছে, ২৩ সালে ১৫০ টন সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে এসেছে। ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে কিছু সোনা এসেছে। বাজারে সোনার চাহিদা ৪০ টন, তাহলে বাকি সোনা কোথায় যায়? নিশ্চয় চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দর হয়ে ২০২৩ সালে ৩১ টনের বেশি সোনা ব্যাগেজ রুলের মাধ্যমে আমদানি করা হয়েছে। ব্যাগেজ রুলের সুবিধাটাকে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। তারা মাসে কয়েকবার বিদেশ গিয়েও স্বর্ণ নিয়ে আসছে। প্রতিবারে ৬০-৭০ হাজার টাকা লাভ করছে। ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহারের কারণে লোকাল ইন্ডাস্ট্রি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার হচ্ছে। যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। শুধুমাত্র ব্যাগেজ রুলের কারণে আমরা প্রতিবছর ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ হারাচ্ছি। তাই সোনার চোরাচালান বন্ধে ব্যাগেজ রুলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কোন যাত্রী ১ বছরের কম যদি বিদেশে থেকে বাংলাদেশে আসে তাহলে তার পাসপোর্টে এনডোর্সের টাকা থেকে সেই সোনা কিনে আনছে কি না, নাকি অন্য কোন উৎসের অর্থ দিয়ে আনছে, কাস্টমসকে তা দেখতে হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুর নূর দুলাল বলেন, আমি আজ এখানে না এলে বুঝতামই না সোনা ব্যবসায়ীরা নির্দোষ। বিনা কারণে আপনাদের অপবাদ দেওয়া হয়। চোরাচালানের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক নেই। আপনাদের যেকোনো সময় সহায়তায় আমি পাশে আছি।
বাংলাদেশ ফাইন্যন্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের উপ-প্রধান কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় বৈধভাবে আনা সোনা অবৈধ চ্যানেলে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীদের নিয়ে আসার কথা রেমিট্যান্স, কিন্তু তারা আনছে স্বর্ণ। কিন্তু এভাবে এটা আনার কথা নয়। সোনা চোরাচালানের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। যেমন মাদক-অস্ত্র দেশে আসছে, কিন্তু এর মূল্য পরিশোধ টাকায় হয় না। তখন স্বর্ণটাকে ব্যবহার করা হয়। সোনা বিনিময়মূল্য পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের বর্ডারগুলো অরক্ষিত। তাই মাদক আর অস্ত্র আসছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির সময় ঘোষণা দেয় পাঁচ টন। কাস্টমসের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পণ্য আনছে ১০ টন। তখন এই বাকি পাঁচ টনের মূল্য পরিশোধ কীভাবে করবে? তখন স্বর্ণের মাধ্যমে এর মূল্য পরিশোধ করা হয়। আমাদের উচিত বর্ডার আরও সুরক্ষিত করা।
বর্তমান সরকার মানি লন্ডারিংসহ সব দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করেছে। জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের কী কী ঝুঁকি আছে, আমরা যাচাই করছি। কিন্তু জুয়েলারি শিল্পের উন্নয়নে বাজুসের সমসমায়িক উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আপনারা যে বিষয়গুলো উত্থাপন করেছেন, সেগুলো যৌক্তিক বিষয়। কীভাবে আপনাদের ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ করা যায়, সরকার উদ্যোগ নেবে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সহযোগিতা করব।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৪
পিএম/আরএইচ