বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতি মাসে এক হাজার ৫০০টিরও বেশি অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এবার ভোক্তা অধিদপ্তরকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সংস্থাটির বর্তমান মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান।
প্রশ্ন : সরকারের নানা পদক্ষেপেও নিত্যপণ্যের দাম কমছে না। বাজার ব্যবস্থাপনায় কী সীমাবদ্ধতা দেখছেন?
উত্তর : নিত্যপণ্যের দাম কমছে না এমন নয়। সবজি, ডিমসহ কিছু পণ্যের দাম আগের তুলনায় কমেছে। তবে কিছু খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে যে প্রত্যাশিত মাত্রায় কমার কথা, সেটি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ভোক্তা অধিকার আইনের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন জড়িত। স্থানীয় প্রশাসন যদি সক্রিয়ভাবে আরো এগিয়ে আসত, তাহলে আলুসহ কিছু কিছু পণ্য আমরা আরো সহনীয় মূল্যে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারতাম।
প্রশ্ন : আপনাদের পদক্ষেপগুলো বাজারের পুরনো সংস্কৃতি পরিবর্তনে কি কোনো প্রভাব রাখছে?
উত্তর : বাজারের শৃঙ্খলার মধ্যে অনেক কিছুই আছে। যথাযথ জায়গায় বাজার বসছে কি না। কেউ চাঁদাবাজি করছে কি না। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী রয়েছে। আর দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রতিদিন ৫০টির বেশি টিম রাজধানী ঢাকাসহ জেলাগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৮ থেকে ৯টি টিম প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
বন্ধের দিনও অভিযান চালাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে অন্য যেসব সংগঠন আছে, তারাও সমানভাবে এগিয়ে এলে বাজারে পজিটিভ প্রভাব পড়বে। বাজারে পুরনো সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা ভোক্তা অধিদপ্তরের একার কাজ নয়।
প্রশ্ন : মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য এবং বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? সেটি বাস্তবায়নে আপনারা এখন মাসে কী সংখ্যক অভিযান চালাচ্ছেন?
উত্তর : ভোক্তা অধিদপ্তর সব সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের নিরুৎসাহিত করে। এতে একটি ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে।
বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতি মাসে এক হাজার ৫০০টিরও বেশি অভিযান হচ্ছে।
প্রশ্ন : জরিমানার পরও অসাধু ব্যবসায়ীরা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। স্থায়ী সমাধানে কী পদক্ষেপ নেবেন?
উত্তর : অন্যায় ও অপরাধের সঙ্গে যখন একটি সমাজের বেশির ভাগ মানুষ জড়িত থাকে সেটা কেবল ভোক্তা অধিকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই পুরনো অভ্যাস ও সংস্কৃতিকে পাল্টাতে পলিটিক্যাল লিডারশিপ এবং সোশ্যাল লিডারশিপকেও এগিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন : সামনে রমজান। এ সময় ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও পণ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা বাড়ে। এ বছর রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রস্তুতি কী?
উত্তর : প্রতিবছর রমজানে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। এবার সরকার আগাম ব্যবস্থা নিয়েছে। রমজানের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সয়াবিন তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, সেমাইসহ বেশ কিছু পণ্যের ডিউটি ও ট্যারিফ কমিয়েছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ব্যবসায়ীরাও আমদানি করছেন। এসব পণ্য যদি বাজারে আসে তাহলে রমজানে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালে থাকবে।
ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও ভেজাল মেশানোর বিষয়টিতে আমরা সব সময় গুরুত্ব দিই। সুনির্দিষ্টভাবে ভেজালের অভিযোগ মিললে আমাদের পক্ষ থেকে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমাদের এখন যে প্রস্তুতি রয়েছে, সেটাকে আমরা আরো বর্ধিত পরিসরে সক্রিয় করতে এরই মধ্যে মতবিনিময় করেছি।
প্রশ্ন : সরকার কয়েকটি নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। সেসব পণ্যের দাম যে হারে কমার কথা তা কমানো হচ্ছে না।
উত্তর : যারা ব্যবসা করছেন তারা যাতে নৈতিকভাবে ব্যবসা করেন এবং তাদের লাভের সীমা কোনোভাবেই অতিমুনাফায় পরিণত হবে না। এই সংস্কৃতি সব ব্যবসায়ীর মধ্যে থাকতে হবে। তারা সচেতন হবেন, তারাও সমাজেরই নাগরিক ও সমাজেরই অংশ। তাদের কারণে সমাজের অপর অংশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এই বিষয়ে সচেতন হতে আমরা ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করি। একই সঙ্গে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
প্রশ্ন : স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। টিসিবির কার্যক্রম কি আরো বাড়ানো প্রয়োজন?
উত্তর : টিসিবি তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। এর আগে যে অভিযোগ ছিল, অনেকে প্রাপ্য নয় এমন অনেকেই ডিলারশিপের মধ্যে এসেছে। যারা বেআইনিভাবে এসেছে তাদের চিহ্নিত করে ডিলারশিপ বাতিল এবং তাদের আইনের আওতায় আনতে টিসিবি চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন : ভোক্তা অধিকার চলতি বছর কতগুলো অভিযান চালিয়েছে?
উত্তর : চলতি বছর আমাদের বাজার অভিযানের সংখ্যা এখন পর্যন্ত সাত হাজার ২৪৫টি। দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৫ হাজার ৩১টি। আর এই সময়ের মধ্যে আমরা জরিমানা আদায় করেছি ৯ কোটি ৯৪ হাজারের বেশি। গত জুলাই ও আগস্টে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে অভিযান চালানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য কোনোভাবেই জরিমানা নয়, সুলভ মূল্যে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য।
প্রশ্ন : ভোক্তাদের সচেতন করতে আপনারা আরো কী ধরনের পদক্ষেপের কথা চিন্তা করছেন?
উত্তর : আমি নিজে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় গিয়ে দেখেছি, ভোক্তারা অনেকটাই অবগত। কারণ জেলায় নিয়োজিত আমাদের সহকারী পরিচালকরা প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাজারে অভিযান চালাচ্ছেন। তারা স্থানীয়ভাবে নানা সংগঠনের সহায়তাও পাচ্ছেন। তার মধ্যে অন্যতম কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। আগামী সপ্তাহে আমাদের রাজশাহীতে একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি রয়েছে। আমরা ভোক্তা অধিদপ্তরকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ভোক্তাদের সচেতন করতে আমরা পোস্টার, লিফলেট, আইন সম্পর্কে প্রজ্ঞাপন দেওয়া, প্রচারমূলক কাজ সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।
প্রশ্ন : ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : পরিকল্পনা হলো আমাদের আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতাগুলো রয়েছে সেগুলো দূর করা। ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে আরো সক্রিয় করা। আমাদের জনবল ও সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে, সেটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
এসআই