ঢাকা, বুধবার, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ১২ মার্চ ২০২৫, ১১ রমজান ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

রংপুর অঞ্চলে আলুর চাষে রেকর্ড হলেও লোকসানের মুখে চাষিরা

হারুন উর রশিদ সোহেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২২ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২৫
রংপুর অঞ্চলে আলুর চাষে রেকর্ড হলেও লোকসানের মুখে চাষিরা ক্ষেতে তুলে রাখা আলু

রংপুর: রংপুর মহানগরীসহ এ অঞ্চলের ৫ জেলায় চলতি মৌসুমে আলুর চাষ হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। তবে এবার দাম না থাকায় লাভের বদলে লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষিরা।

এমন পরিস্থিতি বজায় থাকলে এবার ক্ষেতের আলু ক্ষেতেই পড়ে থাকবে-এমনটা শঙ্কা করছেন অনেকেই। এছাড়াও কোল্ড স্টোরেজে ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন।

চাষিরা বলেন, চলতি মৌসুমে আলুর আবাদ রেকর্ড পরিমাণ হয়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের। কারণ বর্তমানে প্রতি কেজি আলু ১২-১৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ কেজিতে খরচ পড়েছে ২০ টাকার মতো। এতে লাভের আশা তো দূরের কথা, চাষের দেনা পরিশোধ নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অনেক চাষি।

আলু চাষিরা বলছেন, এবার বীজ ও সারের দাম বেশি হওয়ায় প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৯-২০ টাকা। সেই আলু ১২-১৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাদের। অথচ খুচরা বাজারে এখনও আলু প্রতি কেজি ১৮-২৫ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। মাঝখানে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। এ অবস্থায় হাজারো কৃষককে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রংপুর মহানগরীসহ জেলায় চলতি মৌসুমে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমি। অতীতের রেকর্ড ভেঙে চাষ হয়েছে ৬২ হাজার ২৮০ হেক্টরে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত আবাদ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। তবে তা ২০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।

অন্যদিকে রংপুর ছাড়াও রংপুর অঞ্চলের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট জেলায় এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে। সেখানে আবাদ হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ হেক্টর।

চাষিরা জানান, গত মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর দাম উঠেছিল ৭০-৮০ টাকা পর্যন্ত। তাতে কমবেশি সবাই লাভবান হয়েছেন। সেই আশায় এবার বেশি জমিতে আবাদ করেছেন। এবার মৌসুমের শুরুতেই প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৯০ টাকায়। এখন মাঠে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকায়।
এদিকে খুচরা বাজারে আলুর দাম ১৮-২৫ হলেও চাষিদের কাছ থেকে তা ১২-১৩ টাকা কেজিতে কিনে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।

চাষিরা আরও জানান, এক দোন (২৪ শতক) জমিতে আলু চাষ করতে ২৩০ কেজি বীজ ব্যবহার হয়েছে, যার বাজার মূল্য ২৫ হাজার ৩০০ টাকা। এছাড়া সার, কীটনাশক, স্প্রে, শ্রমিক, সেচ ও জমি ভাড়া মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী ফলন বিক্রি করে এ খরচ উঠবে না বলে তারা জানান।

বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর এলাকার চাষি হাফিজার রহমান জানান, তিনি ৩৬ শতক জমিতে আলু চাষ করেছেন। গত বছরে নিজের বীজ আলু থাকায় অন্যান্য খরচ বাবদ প্রায় ২৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। কিছু আলু বিক্রি করেছি তাতে আশানুরূপ লাভ হয়নি। বাকি আলু উত্তোলন করলেও তেমন লাভ হবে না। যদি কোল্ড স্টোরেজে রাখি তাতেও সমস্যা, কারণ এবার কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া বেড়েছে।

বদরগঞ্জ উপজেলার শামপুর বৈকন্ঠপুর এলাকার চাষি লুৎফর রহমান বলেন, এবার ফলন ভালো হয়েছে। দাম না থাকায় কোল্ড স্টোরেজে রাখবো। কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধি করায় তারা বিপাকে পড়েছেন। ভালো দামের আশায় তারপরেও স্টোরেজে রাখবো।
রংপুর সদরের লাহেড়ীরহাট এলাকার চাষি আরজ আলী বলেন, তিনি ১৩ দোন (২৪ শতকে একদোন) জমিতে আলু চাষ করেন। প্রতি দোনে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তিনি ব্যাংক থেকে চার লাখ টাকা লোন করে এই আলুর চাষ করেন। এবার আলুর ব্যাপক চাষ হওয়ায় দাম বর্তমানে কম। দাম বাড়বে কিনা তাও সন্দিহান।

তিনি আরও বলেন, দাম না থাকলে আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখবো। এবার প্রতি কেজি ৮ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক কোল্ড স্টোরেজে অগ্রিম ১ থেকে ২শ টাকা চাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে আলু উত্তোলন খরচ তো আছে। তবে জায়গা পাবো কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ দাম কম থাকায় অনেকেই আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখবে।

রংপুর নগরীর জলকরিয়া এলাকার মিজানুর রহমান বলেন, অনেকেই আলু নিয়ে চিন্তিত। আলুর যদি দাম বেশি থাকতো তাহলে একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন বলে তিনি জানান। তবে সরকার যদি বিদেশে আলু রপ্তানি করে তাহলে চাষিদের জন্য ভালো হতো।

পীরগাছা উপজেলার চাষি শহিদুল ইসলাম ও ফুল মিয়া বলেন, বেশি লাভের আশায় ঋণ করে দুজনে দুই একর জমিতে আলু চাষ করেছি। এখন লাভ তো দূরের কথা, ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি।

অরেক চাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই আলু হিমাগারে রাখতে গেলেও খরচ বেশি। কারণ হিমাগারের খরচ এবার বাড়ানো হয়েছে। সেখানে রেখেও যদি পরে দাম না পাই সে ভয়ে এখনই বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। ’

রংপুর সিটি বাজার পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ আলী বলেন, তারা সরাসরি চাষির কাছ থেকে আলু কেনেন না। তারা পাইকারি হাট থেকে কেনেন। সেখান থেকে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে দুই-তিন টাকা লাভে বিক্রি করেন। তবে এটা সত্য, এবার কৃষকরা আলুর ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। কারণ বাজারে দাম কম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আফজাল হোসেন জানান, রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আলু চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিবছর রংপুর অঞ্চলে আলু চাহিদার চেয়ে উদ্বৃত্ত থাকে। উৎপাদিত আলু দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বাদে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগ সব সময় চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছে। চাষিরা কোল্ড স্টোরেজের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে আলু সংরক্ষণ করলে এখন যে বাজার মূল্য তার চেয়ে বেশি পাবে বলে আশা করি।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।