ঢাকা, সোমবার, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৯ জুন ২০২৫, ১২ জিলহজ ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

এবারও চামড়া নিয়ে বিপাকে ব্যবসায়ীরা, নানা কারণে দরপতন

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:৪০, জুন ৮, ২০২৫
এবারও চামড়া নিয়ে বিপাকে ব্যবসায়ীরা, নানা কারণে দরপতন

ঢাকা: কোরবানির পশুর চামড়ার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তেমন কোনো কাজে আসেনি। এবারও চামড়া নিয়ে চরম বিপাকে সরকার ও ব্যবসায়ীরা।

সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কমে বিক্রি হচ্ছে গরু ও ছাগলের চামড়া। রাজধানীসহ বিভাগীয় অনেক শহরের সড়কে চামড়া পড়ে থাকলেও ক্রেতাদের দেখা মিলছে না। ফলে বাধ্য হয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করছেন কোরবানিদাতারা। তারা সংগ্রহ করে পানির দরেই বিক্রি করছেন পশুর চামড়া। গরুর চামড়া ঢাকায় আকারভেদে ৪শ থেকে ৭৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩শ থেকে ৪শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া সর্বনিম্ন ১৩শ ৫০ টাকা ও ঢাকার বাইরে ১১শ ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ছিল। আর গতবারের মতো এবারও ছাগলের চামড়ার চাহিদা নেই বললেই চলে। অনেকেই বিনামূল্যে ছাগলের চামড়া দিয়ে দিয়েছেন, অনেকক্ষেত্রে দাম উঠেছে ১৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। দাম কম থাকায় লোকসানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।  এদিকে দাম কম হওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি  সিদ্ধান্তে সাধারণ ব্যবসায়ীদের কোনো লাভ হয়নি। হাতে গোনা কয়েকটি ট্যানারি মালিক লাভবান হয়েছেন। আর রপ্তানিকারক একমাত্র দেশ চীন হওয়ায় তারা এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন। তারা নানা অজুহাতে চামড়ার ন্যায্যদাম দেন না। পাঁচ ডলারের চামড়া দেড় ডলার দেয়। এতে ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে কিনে লোকসানে পড়তে চায় না।  

এ ছাড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সময় মতো চামড়া আনেন না। ঈদের দিন বৃষ্টি হওয়া অনেক চামড়ার টেম্পার চলে গেছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে অর্থ বিনিয়োগে সতর্কতা, অনেক ব্যবসায়ী চামড়া কিনছেন না এবং ব্যাংক ঋণ ও বেশি দাম বেঁধে দেওয়ায় এবছরও চামড়া দামে দরপতন হয়েছে।  

প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত ওয়েট ব্লু চামড়া বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হতো। এরপর শুধু ২০২১ সালে কেস টু কেস ভিত্তিতে এক কোটি বর্গফুট ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেয় সরকার। এবছর কাঁচা-ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হলো। বাংলাদেশ থেকে সব সময় চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান ও স্পেনের মতো দেশে ফিনিশড চামড়া যায়। ওইসব দেশেই কাঁচা-ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে চীন ও ভিয়েতনামে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পশুর চামড়া আমদানি করার জন্য।

রোববার (৮ জুন) রাজধানীর পোস্তাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত দরে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। গত বছরের কাছাকাছি দরে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। কোরবানিদাতাদের থেকে তারা আকারভেদে প্রতি পিস চামড়া সর্বোচ্চ ২শ থেকে ৫শ টাকায় কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা সেই চামড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেছেন ৬শ থেকে ৯শ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া কেনায় ব্যবসায়ীদের কোনো আগ্রহ নেই বলেই দেখা গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তায় চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে।  

সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১৫শথেকে ১৬শ ২৫ টাকা। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে রোববারও দুপুরের পর পোস্তায় কাঁচা চামড়া আসতে শুরু করে। আর আড়তদারদের হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠেছে লালবাগের শায়েস্তা খান, রাজ নারায়ণ ধর রোডসহ আশপাশের বিভিন্ন রোড। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিনিধিরা ট্রাক, ভ্যান ও রিকশায় করে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসেন। আড়তদাররা সেই চামড়া দরদাম করে কেনেন। তবে এবছর ঈদের দ্বিতীয় দিন অনেক পশু কোরবানি হয়েছে তাই চামড়াও অনেক আসছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এখানে চামড়া সংগ্রহের পর প্রথমে লবণজাত করা হবে। পরে তারা সাভারের ট্যানারিগুলোতে পাঠিয়ে দেবেন। এদিন লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। সেখানে রোববার বিকেলে ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৪শ, ৬শ ও ৯শ টাকায় বিক্রি হয়েছে।  

রাজধানীর উত্তরার থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. আব্দুল রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানিদাতাদের থেকে ৭৫০ টাকায় চামড়া সংগ্রহ করে রীতিমতো বিপদে পড়েছি। পোস্তায় সেই চাড়মা বিক্রি করেছি ৮৫০ টাকায়। একেবারে ছোট চামড়ার দাম ৪৫০ থেকে ৫শ টাকা। আর সবচেয়ে বড় চামড়ার দাম এক হাজার টাকা পর্যন্ত দাম দিচ্ছে। কিন্তু আমরা এখন আর চামড়া কিনতে পারিনি মাদ্রাসার জন্য। মাদ্রাসার ছেলেরা দুই দিন আগেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া চেয়ে আসে। মানুষও মাদ্রাসায় চামড়া দান করে দেয়।

মৌসুমি ব্যবসায়ী জমীর উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, পিকআপভ্যানে করে ১৫০ পিস চামড়া এনেছি। গড়ে প্রতিটি চামড়ার দাম ৬শ থেকে ৭শ টাকা দরে কেনা। একেকটি চামড়া বিক্রির জন্য দাম চান ১২শ টাকা করে। তবে আড়তদার বা ট্যানারির মালিকের প্রতিনিধিদের কেউই ৭৫০ টাকার ওপরে দাম দিতে চাননি। শেষ পর্যন্ত ৭৫০ টাকা দরেই সব চামড়া বিক্রি করেছি। লোকসান করেই চামড়া বিক্রি করতে হলো। সারাদিনের ভ্যান ভাড়া আর একজন সহকারীর মজুরি দিয়ে কিছুই থাকবে না। এমন হবে আগে জানলে এত দাম দিয়ে চামড়া কিনতাম না।

এ বিষয়ে পোস্তায় ৫০ বছর ধরে ব্যবসা করেন হাজি মো. সুজাউদ্দিন তালুকদার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দিনের বেলায় চামড়া দাম ঠিক থাকে। রাত হলে চামড়ার দাম কমে যায়, কারণ তখন চামড়ার টেম্পার থাকে না।  অনেক চামড়াতো নষ্ট হয়ে যায়। তখন ফড়িয়ারা আমাদের হাতে পায়ে ধরে।  তখন আমরা একটা দাম ধরে চামড়া নেই। সেটাকে আপনি পানির দাম বলতে পারবেন না। সেটা যদি আমরা না করতাম তাহলে এই চামড়াটা ফেলে দিতে হবে। আমরা যে তাদের বেশি দাম দেবো, আমাদেরওতো বিক্রি করতে হবে। আমরা তো সেই চামড়াটা বিক্রি করতে পারিনি। তাহলে বেশি দাম দিয়ে কিনে কি লাভ। এ ছাড়া বাজারে আগের সিন্ডিকেট কাজ করছে। এবছর অনেক বড় ব্যবসায়ী টাকার অভাবে চামড়া কিনতে পারেননি।  

আমাদের চামড়ার বাজারে চলে যাচ্ছে চীন ও ভারতে হাতে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সবাই রপ্তানি করতে চাই। কিন্তু চাহিদা নেই। ট্যানারি মালিকরা ঠিক মতো টাকা দেয় না। বাংলাদেশের চামড়া কেউ নিতে চায় না। পাঁচ ডলারের চামড়া দেড় ডলার বিক্রি হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের বর্ডারের চামড়া সব ভারতে চলে যায়। আর চীন একক আমদানিকারক দেশ হিসেবে। যখন যে দাম মনে করে সেটা দিয়ে থাকে। তারা আমাদের দেশ থেকে চামড়া নিয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে। ফলে সরকারের রেট দিয়ে আমরা কি করবো। আমাদের চামড়ার বাজার বহুমুখী করণ করতে হবে। ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশে যেতে হবে। তাহলে দেশের বাজারে চামড়ার দাম বাড়বে।  



পোস্তার ফারুক অ্যান্ড সেলিম কোং মালিক মো. সেলিম মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমরা চীনের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। ইউরোপের ক্রেতারা আসে না। ফলে চীন চামড়া কিনে দ্বিগুণ দামে চামড়া বিক্রি করে। চীন এখন আমাদের দেশে নিজেরা কাঁচা চামড়া কিনছে। ট্যানারি ভাড়া করছে। মন গড়া দাম দিয়ে চামড়া কিনছে। আর আমাদের কেমিক্যালের দাম অনেক বেশি হওয়ায় চামড়াটা যে প্রসেস করবো সেখানে খরচ বেশি হয়। অথচ রপ্তানি করতে গেলে দাম পাওয়া যায় না। চীন ছাড়া আমাদের কোনো পাটি নেই। সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।

তিনি বলেন, আজকে প্রতি পিস গরুর চামড়া ৬৫০-৮০০ টাকায় কিনছেন। একেকটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ পড়ে যাবে ৩৫০-৪০০ টাকা। বাজার মন্দা, সে জন্য গতবারের চেয়ে কিছুটা কমে কিনছেন। এ ছাড়া পোস্তায় এখন চামড়া কম আসে। হেমায়রতপুর ট্যানারি মালিকরা এখন কাঁচা চামড়া কিনে। বড় ব্যবসায়ীরা চড়া কিনছেন না। ট্যানারি মালিক টাকা দেননি। তাই চামড়া কিনতে পারছেন না। ব্যবসায়ীরা আসেন যে দাম পায় নিয়ে চলে যায়। এ ছাড়া বাজারে এখন আর ফড়িয়া নেই, যে চামড়া আসে সেটা মাদ্রাসা থেকে আসে। তাদেরতো চামড়া কিনতে হয় না। তারা গাড়িভাড়া ও শ্রমের মূল্য পেলেই খুশি হয়ে যায়। তাদের চামড়ার প্রতি দরদ কম। চামড়া ভালো না মন্দ সেটা তারা বুঝতে চায় না। তারা সারাদিন চামড়া সংগ্রহ করে রাতে যখন চামড়া নিয়ে আসে তখন চামড়ার টেম্পার চলে যায়। ফলে কম দামে বিক্রি করে দিতে হয়। এটাই বাস্তবতা।

পোস্তার শাকিল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো, শাকিল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, চামড়ার দাম কম এবছর, শ্রমিক সংকট, লবণ কম, অতিরিক্ত গরম, বৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক বড় ব্যবসায়ী চামড়া কিনছেন না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে সেটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। ওয়েটব্লু চামড়া রপ্তানি বন্ধ করায়, শুধু হাতে গণা কয়েকটি ট্যানানি রপ্তানি করতে পারে। ট্যানারিরা আমাদের টাকা দিচ্ছে না। কাঁচা চামড়া রপ্তানি করতে পারলে ভালো হতো দাম ভালো পেতাম। সরকার ঘোষণা দিয়ে শেষ। রপ্তানি করতে হলে সক্ষমতা থাকতে হয়। সেটাতো আমাদের নেই। ফলে হাতে গোনা কয়েকটি ট্যানারি মালিক সে সুবিধাটা নেবেন।

এদিকে গাজীপুরে বিগত বছর মতো এবারও চামড়ার দাম কম। ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের পশুর চামড়ার গড় মূল্য নির্ধারণ করে ৬শ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি করে থাকে। এ ছাড়া পাইকারী ব্যবসায়ীদের ও আনাগোনা কম। পশুর চামড়া বিক্রি করতে ঘুরতে হয় ব্যবসায়ীদের ধারে। এতে চামড়ার মূল্য আরও কমে যায়।  

চামড়া ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন জানান, আমরা বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া সংগ্রহ করে বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। তারাও দাম দিয়ে চামড়া নিতে চায় না। তারা আমাদের দাম কম দেয় এতে আমাদেরও কম দামে চামড়া কিনতে হয়। চামড়া কেনার পরেও পরিবহনসহ বিভিন্ন খরচ হয়ে থাকে। সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে বেচাকেনা হয় না।  

ফেনীতে চামড়া নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন মানুষ। শহরের মূল সড়ক থেকে পাড়া মহল্লার অলিগলি। সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পশুর চামড়া। বড় বড় স্তুপ হয়ে থাকলেও দেখা মিলছেনা ক্রেতার। বলতে গেলে পানির দরেই বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৩শ টাকা ও ছাগলের চামড়া ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় বড় গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৩শ টাকায় নেওয়া হয়। ছোট গরুর চামড়া ১শ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। চামড়ার বাজারে ধস নামায় বঞ্চিত হয়েছেন দুস্থরা। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকায় বসে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ চামড়ার বাজার। সেখানে গরুর চামড়ার দাম আকার অনুযায়ী ৪শ থেকে ৭শ টাকা। কিন্তু ছাগলের চামড়া বিক্রিই করতে পারিনি কেউ। দাম না পেয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে গেছেন অনেকেই।  

এ বাজারে চামড়া বিক্রি করতে আসা সোহেল ইসলাম বলেন, এবার ৮০ হাজার টাকা দিয়ে একটা গরু কেনা হয়েছিল কোরবানি করার জন্য। ওই গরুর চামড়া বিক্রি করতে আনছি। এখানে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার বেশি দাম বলতেছে না। এই দামেই বিক্রি করলাম।  

ভোলায় বর্তমানে গরুর চামড়া প্রতি পিস ৭৫০ থেকে ৮শ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকায় সংগ্রহ  করা হচ্ছে। এর বাইরে চামড়া সংরক্ষণে শ্রমিক মজুরি এবং ট্যানারি মালিক পর্যন্ত পৌঁছতে খরচ বেড়ে যাওয়া সরকার নির্ধারিত দাম পাবেন কি না তা সময়ের অপেক্ষা ব্যবসায়ীদের।  

এ বিষয়ে আড়তদার মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রতিবছরই লাভের আশায় চামড়া কিনি কিন্তু একবারও লাভের মুখ দেখিনি, কারণ চামড়ার দাম উঠা-নামা করছে, এখন পর্যন্ত ১০ হাজার পিস চামড়া কিনেছি। এখন অপেক্ষা করছি দাম কেমন পাবো তা নিয়ে। এ বছর লবণ, শ্রমিক ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির কারণে চামড়া বিক্রি নিয়ে চিন্তিত তারা।  

খুলনায় এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায়নি। অনেকেই পানির দরে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। সরকার এবছর কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বাড়ালেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি। বিশেষ করে গরুর কাঁচা চামড়া আগের মতোই কমদামে কেনা-বেচা হচ্ছে। আর অন্যান্য বছরের মতো এবারও ছাগলের চামড়ার প্রতি আগ্রহ দেখাননি অধিকাংশ আড়তদার, যা নিয়ে চামড়া বিক্রেতারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। খুলনায় ছোট গরুর চামড়া ১৫০-২০০ টাকা এবং বড় গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

খুলনা জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম ঢালী বাংলানিউজকে বলেন, সত্যিই বলছি, পানির দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। খুলনার ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী এবার চামড়া কেনেননি। কেনার উপায়ও নেই—চামড়া সংরক্ষণের কোনো মার্কেট নেই, রাস্তায় রাখলে পুলিশ বাধা দেয়, আর লবণের দাম এত বেশি যে সংরক্ষণে লাভ হয় না। এ কারণেই ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। কোরবানির মৌসুমে সরকার দাম বাড়ায়, পরে ট্যানারি মালিকরা দাম কমিয়ে দেয়। এতে চামড়ার বাজারে লস গুনতে হয়।

নীলফামারীর ও সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীদের ঢাকার ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের কাছে প্রায় এক কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। পাওনা টাকা না পাওয়ায় পুঁজির সংকটে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ফলে এবারের কোরবানির মৌসুমে চামড়া কেনার যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেননি তারা। বর্তমানে সৈয়দপুরের স্থানীয় বাজারে গরুর চামড়া আকারভেদে ৪০০-৫০০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ৮০-১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

জানা গেছে, রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্পকে দূষণমুক্ত পরিকল্পিত শিল্পনগরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। ২১ বছরেও এই চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। সাভারের হেমায়েতপুরের ২শ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি (কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার) পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় পাশের ধলেশ্বরী নদী দূষণের শিকার হচ্ছে।  

চামড়াখাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়ার বড় ক্রেতা বর্তমানে চীন। তারা মূল্য কম দেয়।

এবারের ঈদে সব মিলিয়ে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ট্যানারি মালিকরা। এর সিংহভাগ সংগ্রহ হয়েছে ঈদের প্রথম দিনেই। ঈদের দিন কাঁচা চামড়া আসার এই হারও ছিল সন্তোষজনক। যদিও গতবারের চেয়ে প্রতি পিস চামড়া কিছুটা বেশি দরে কিনছেন বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, চামড়া বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য মেলেনি। গতবারের চেয়েও দাম কম।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, এবার চামড়ার মূল্য বরং স্থিতিশীলই ছিল। লবণ ছাড়া ভালো মানের গরুর কাঁচা চামড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। হেমায়েতপুর ট্যানারিতে আজ সকাল পর্যন্ত চার লাখ পিস কাঁচা চামড়া ঢোকছে। আমরা আগেই বিভিন্ন মাদ্রাসার সাথে চুকবতি করে রেখেছিলাম। এবছর গত বছর থেকে প্রতি পিস চামড়ার দাম অন্তত ৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। তবে আর যেসব গরুর চামড়া আকারে তুলনামূলক ছোট ও মান কিছুটা খারাপ, সেগুলোও উপযুক্ত দামে বিক্রি হয়েছে। আর লবণযুক্ত চামড়ার বেচাকেনা এখনও শুরুই হয়নি। দুই/একদিনের মধ্যে শুরু হলে সেটার দামও স্থিতিশীল থাকবে বলেই আশা করছি।

তিনি বলেন, এবছর পশু কোরবানি কম হয়েছে। আমরা এবছর ৮০ থেকে ৮৫ লাখ পিস চামড়া সংরক্ষণ করবো। চামড়ার দাম নিয়ে যে সমস্যাটা হয় সেটা মূলত সরকারের ব্যবস্থাপনা ঘাটতির কারণে হয়েছে। সরকারকে আগে চামড়ার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। চীনের একচেটিয়া আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাজার ধরতে হবে।

আমরা রপ্তানি করতে পারলেতো চামড়া কিনবো। একক বাজার হওয়ায় চীন দাম কম দিয়ে থাকে। আমরা যদি লাভ করতে না পারি তাহলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দাম পাবে কোথা থেকে বলে জানান তিনি।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বাংলানিউজকে বলেন, সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তিন মাসের জন্য তুলে নিয়েছে সেটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আমাদেরতো সেই সক্ষমতা নেই চামড়া রপ্তানির জন্য। আমাদের আগে সক্ষম করে তুলতে হবে। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।  

তিনি বলেন, ঈদের দিন দিনের বেলায় যেসব চামড়া এসেছে সেগুলো ভালো চামড়া সেগুলোর দাম এক হাজার ১২শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। কিন্তু রাত ৯টার পর যে চামড়াগুলো আসে সেগুলোর টেম্পার চলে যায়। তখন আড়তদাররা নিতে চায় না, তখন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হাতে পায়ে ধরে চামড়া দিয়ে যায়। তখন আড়তদাররা এভারেজে একটা দাম দিয়ে দেয়। না হলে তো সেই চামড়াগুলো পচে যাবে। এজন্য বলে চামড়ার দাম কমেছে। আসলে ভালোটার দাম ভালো মন্দটার দাম একটু কমই থাকে।  

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেশি ছিল। সেবার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৮৫-৯০ টাকা। তারপর থেকে বিভিন্ন কারণে চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক অঞ্চলে চামড়া সড়কে ফেলে ও মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তাতে প্রায় ২৪২ কোটি টাকার চামড়ার নষ্ট হয়।

গত ২৬ মে কোরবানি পশুর চামড়ার এই দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০-৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। এছাড়া ঢাকায় কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া আর পানির দামে কেনার সুযোগ থাকছে না। চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে চামড়ার দামও গতবছরের তুলনায় পাঁচ প্রতি বর্গফুটে বাড়ানো হয়েছে। কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে  দেশের মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ প্রদান, করা হয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়া দাম নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বর্তমান সরকার। বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখেই অভ্যন্তরীণ বাজারের কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া দামে কেনা-বেচা হলে কোনো ধরনের লোকসানের আশঙ্কা থাকবে না। আর প্রতিবছর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসানের মুখে ফেলে দেয় চামড়ার বাজারের সিন্ডিকেট। এজন্য সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে কাঁচা চামড়া তিন মাসের জন্য সরাসরি রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া নির্ধারিত দামের বাইরে যারা চামড়া কেনা-বেচা করবে কিংবা যারা জাতীয় এই সম্পদ বিনষ্টে কাজ করবে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে দেশের সব জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আগে-ভাগে নির্দেশনা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে কাঁচা চামড়া তাড়াহুড়ো বিক্রি না করে কিছুদিন যাতে সংরক্ষণ করা যায় সেজন্য লবণের সরবরাহ বাড়ানো হবে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে প্রায় আরও এক লাখ টন লবণ দেশে দেওয়া হবে।  

এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, আমরা যেহেতু বিনামূল্যে লবণ দিচ্ছি, প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং চামড়ায় লবণ লাগাতে যে শ্রম ব্যয় হয়, সেসব বিবেচনায় নিয়েই এবার চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছি। ফলে এবার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা যৌক্তিক। পাশাপাশি চীনের ও ভিয়েতনামে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এবার ঈদুল আজহায় কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি। এরমধ্যে কোরবানিযোগ্য ৫৬ লাখ দুই হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া ও পাঁচ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীর প্রাপ্যতা রয়েছে। এ বছরও ২০ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থাকতে পারে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বছরে দেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, দুই দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং এক দশমিক দুই শতাংশ ভেড়ার চামড়া।  

জিসিজি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।