ঢাকা: আমিনুল ইসলাম (ছদ্মনাম) বিকেল ৫টায় অফিস ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় তার বস (উর্ধ্বতন কর্মকর্তা) তাকে ডাকলেন।
খাম খুলে ভেতরের চিঠি পড়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। আমিনুল ইসলামের আর চাকরি নেই। ২২ বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন মাত্র একটি চিঠির মাধ্যমে অবসান ঘটলো তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের। সঙ্গে অনেক লালিত স্বপ্নেরও।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এ এক সত্য গল্প। নামটি ছদ্ম এই কারণে যে, চাকরিচ্যুত ওই ব্র্যাককর্মী এখন তার ২২ বছরের চাকরির কিছু সার্ভিস বেনিফিটের অপেক্ষায়। তার আশঙ্কা নাম জানাজানি হলে ব্র্যাক তাকে ওই বেনিফিট দেবে না। তবে এমনিতেও বেনিফিট পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকট আমিনুলের।
গত এক সপ্তাহে বাংলানিউজের কাছে ব্র্যাক থেকে এমন চাকরিচ্যুতদের ডজনখানেক মেইল এসেছে, তারা নাম প্রকাশ করতে চাইছেন না। এদের মধ্যে নারীও রয়েছেন বেশ কয়েকজন। আর অনেকেরই ‘আমিনুলের’ মতো ২০ থেকে ২২ বছরের চাকুরির অবসান ঘটেছে মাত্র কয়েক মিনিটের নোটিশে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও, এমন তকমা ব্র্যাকের নামের সঙ্গে। কিন্তু সেখানে এখন চলছে অনৈতিক, অবৈধ গণছাঁটাই।
অভিযোগ ডজনখানেক হলেও তারা শত শত চাকরিচ্যুত ব্র্যাক কর্মীর প্রতিনিধি।
চাকরির শেষ দিনটিতেও দিনভর খাটিয়ে সন্ধ্যায় একটি মাত্র চিঠি ধরিয়ে বিদায় করা হচ্ছে।
তবে বাংলানিউজ ‘আমিনুল’ ছদ্মনামের যে কেসস্টাডি এখানে তুলে ধরছে তার আরও একটি বেদনাদায়ক কিংবা উদ্বেগের দিক রয়েছে।
বাংলানিউজ জেনেছে, যেই বস (উর্ধ্বতন কর্মকর্তা) আমিনুলকে চাকরিচ্যুতির চিঠিটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন দিন কয়েক পরে একই পদ্ধতিতে ওই কর্মকর্তাকেও চিঠি ধরিয়ে দিয়েছেন তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
প্রশ্ন উঠতেই পারে ব্র্যাকে হচ্ছে টা কি?
সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ‘আমিনুল’র কথা আরও একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। চল্লিশের কোটায় আমিনুল। টগবগে তরুণ হিসেবে ব্র্যাকে চাকরি নেন। নিজের যোগ্যতা দক্ষতার সবটুকু ঢেলে দিয়ে কাজ করেন এই এনজিওতে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে আরো অনেক চাকরির প্রস্তাব ছিল। ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানে চাকরি, বেতনও সেসময়ের সরকারি চাকরির দ্বিগুন। তাই আর দেরি না করে ব্র্যাকের চাকরিই বেছে নেন। কিন্তু এখন এই মধ্যবয়সে তাকে নতুন করে শুরু করতে হবে!
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কিভাবে চলবে তার? দুই সন্তানই পড়াশুনা করছে। তাদের পড়াশুনাইবা কিভাবে হবে? হাজারো দুশ্চিন্তা নিয়ে তার দিন কাটছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জীবনের সেরা দিনগুলো এই প্রতিষ্ঠানেই দিয়েছি। আর তার ফল পেলাম এইভাবে!
দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ব্র্যাকের মাঠ পর্যায় থেকে প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত সবস্তরেই চলছে এই ছাঁটাইয়ের কাঁচি।
বিভিন্ন প্রকল্পে গণহারে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। বিনা নোটিশে এ পর্যন্ত অন্তত এক হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এর বাইরে চাকরিচ্যুতির একটি আরো তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। অচিরেই আরো কর্মীকে ছাঁটাই করা হবে, দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায় বাংলানিউজকে।
সবচেয়ে বেশি চাকরিচ্যুতি হয়েছে ওয়াটার স্যানিটেশন এন্ড হাইজিন প্রকল্পে। এই একক প্রকল্প থেকে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় তিনশ জন। দু’শতাধিকের বেশি চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে হেলথ নিউট্রিশন প্রোগামে।
ব্র্যাকের এডুকেশন প্রোগ্রামের সুনাম রয়েছে সারাদেশে। অথচ এই প্রকল্প থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে আড়াই’শ জনকে।
আর মাইক্রো ফিন্যান্স থেকে বিদায় করা হয়েছে ২০০ কর্মীকে।
ব্র্যাকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, বেশ কয়েক মাস আগে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের পারফরম্যান্স রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব রিপোর্ট দেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় চিঠি দেওয়া। একে একে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা এই চিঠি পাওয়া শুরু করলেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আজ শুনি ওমুক চিঠি পেয়েছেন। কাল শুনি আরেকজন চিঠি পেয়েছেন। শুধু আমার এলাকার নয়, সারাদেশ জুড়েই এভাবে চিঠি দেওয়ার খবর পাচ্ছি।
এখনও চাকরিতে রয়েছেন এই কর্মকর্তা। বলেন, পুরো ব্র্যাকের জুজুর ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। আমি নিজেও ভয়ে আছি। কাল না আমার বিদায়ী চিঠি আসে। এখন প্রতিটি দিন চিঠির আতঙ্ক নিয়েই অফিসে যাই।
এনিয়ে ব্র্যাকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা মুখ খুলছে না, তবে ভেতরের তথ্য হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটিকে আরো গতিশীল ও বেগবান করতে পুরাতনদের বাদ দিয়ে নতুনদের সংযোজন করার নব্য নীতিই এই ছাঁটাইয়ের কারণ। ব্র্যাক কর্তৃপক্ষের ভাষায় ‘ফ্রেশ ব্লাড’ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে আমিনুল বলেন, ‘আমি যে অযোগ্য তা জানতে ব্র্যাকের যদি ২২ বছর লেগে যায়, তাহলে আমি বলবো ব্র্যাক নিজেই একটি ‘অযোগ্য’ সংস্থা। তাদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও নাম ধরে বিদেশি ফান্ডের ব্যবহার করার সুযোগ থাকা উচিত নয়।
কর্তৃপক্ষের দাবির সঙ্গে বাস্তবতারও মিল পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ চাকরিচ্যুতদের মধ্যে ২০-২২ বছরের পুরোনো কর্মী যেমন রয়েছেন, তেমনি ৫-৭ বছর চাকরির বয়স এমন কর্মীও রয়েছেন। তাহলে ‘ফ্রেশ ব্লাড’ কথাটিও ধোপে টেকে না।
আর চাকরিচ্যুতির পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ কারণই দেখাচ্ছে না ব্র্যাক।
নাম প্রকাশ না করে চাকরিচ্যুত অপর এক ব্র্যাক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, সত্যি বলতে, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যা বলেছে তা পুরোপুরি মিথ্যা, বানোয়াট।
অকারণে এভাবে চাকরি যাওয়ার ঘটনা ব্র্যাকে নজিরবিহীন। একদিন এর বিচার আল্লাহ নিজেই করবেন, বলেন এই অসহায় চাকরিচ্যুত কর্মী।
ব্র্যাকের মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলেন, কাউকে কাউকে মিথ্যা অভিযোগ এনেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরোনো অভিযোগ যা অনেক আগেই প্রমাণিত না হওয়ায়, বাতিল হয়ে চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে, সে অভিযোগ নতুন করে চাঙ্গা করে চাকরিচ্যুত করার সুযোগ খুঁজছে ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ।
অনেকের ক্ষেত্রেই এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ এনে চাকরি থেকে বিদায় করা হয়েছে একদম খালি হাতে। এরা সার্ভিস বেনিফিট থেকেও বঞ্চিত।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের বক্তব্য জানতে সংস্থার কমিউনিকেশন বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মাহবুবুল আলম কবীরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি ব্র্যাকের মুখপাত্র নই।
এর আগেই বাংলানিউজের ‘ব্র্যাকে কী হচ্ছে?’ ঘোষণার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাহবুবুল হককে ঘোষণায় উল্লেখ করা ই-মেইলে তাদের বক্তব্য পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সেখানেও তাদের পক্ষ থেকে কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি।
তবে ওই ই-মেইলে অ্যাকাউন্টে শত শত ই-মেইল এসেছে। বাংলানিউজ সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে প্রায় শতভাগই ব্র্যাকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানেও রয়েছে ব্র্যাকের স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, উত্তরাধিকারের পরম্পরার নানা তথ্য। এসবের ভিত্তিতে আসবে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পরবর্তী কিস্তি।
বাংলাদেশ সময়: ০২০০ ঘন্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৪
** পথ নষ্ট হয় ট্রাকে, মানুষ নষ্ট হয় ব্র্যাকে!
** ব্র্যাকে কী হচ্ছে!