ঢাকা: বেদখল হওয়ার দেড় মাসের মধ্যে প্রগ্রেসিভ লাইফের দখল ফিরে পেয়েছেন বজলুর রশিদ চৌধুরীরা। রোববার (২১ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ৬টার দিকে পুলিশের সহায়তায় কোম্পানিটির পাল্টা দখলে নেয় বজলুর রশিদের অনুসারী পরিচালকেরা।
এর আগে গত ৯ নভেম্বর চেয়ারম্যান পদ থেকে বজলুর রশিদকে সরিয়ে প্রগ্রেসিভ লাইফের দখল নেয় তার বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত) এমএ করিমের অনুসারীরা।
দখল ফিরে পাওয়ার বিষয়ে বজলুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, আদালতে নির্দেশে আমি চেয়ারম্যানের পদ ফিরে পেয়েছি। আদালতে নির্দেশের কপিসহ আমি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে রোববার পুলিশ প্রগ্রেসিভ লাইফের দখল ফিরে পেতে আমাদের সহায়তা করেছে।
তিনি বলেন, আদালত এমএ করিমের অনুসারী পরিচালকদের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে চারটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়েছে। আদালতের রায়ে তার (বজলুর রশিদ) চেয়ারম্যান পদে থাকা নিয়ে বিরোধী গ্রুপকে ঝামেলা না করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি কোম্পানির ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের হিসাব নিরীক্ষার জন্য হুদাভাসিকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এ জন্য নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানটির জন্য বার্ষিক ২ লাখ টাকা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে এর আগে হুদাভাসির নিরীক্ষায় ওঠে আসা কোম্পানির আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) আদালত নির্দেশ দিয়েছে বলে জানান বজলুর রশিদ।
এর আগে গত ৯ নভেম্বর এমএ করিম’র অনুসারী পরিচালকদের এক জরুরি বৈঠকের মাধ্যমে চেয়ারম্যান বজলুর রশিদকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নতুন করে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান পদে বসানো হয় আব্দুল মালিক নামের একজন পরিচালককে।
বৈঠকের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি পরিবর্তন করা হয় কোম্পানি সচিবকে। আগের কোম্পানি সচিব নুরুল আমিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন করে কোম্পানি সচিব করা হয় এমএ মান্নান নামের এক কর্মকর্তাকে। পাশাপাশি আইন কর্মকর্তা শাহিন আহমেদকে মারধর করে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
ওই দিন অর্থাৎ ৯ নভেম্বর বাংলানিউজে ‘বিরোধী পক্ষের দখলে প্রগ্রেসিভ লাইফ’ শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এদিকে প্রগ্রেসিভ লাইফ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং’র এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এমএ করিম, সাবেক সিনিয়র মহব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব শাখা) এনায়েত আলী খান, সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (সুজন বিমা বিভাগ) মো. মনিজুজ্জামান খান এবং সিনিয়র ব্যবস্থাপক (ইসলামী বিমা তাকাফুল বিভাগ) মো. রফিকুজ্জামান অনুমোদনহীন ভূয়া এজেন্টের নামে নিয়ম বহির্ভূত কমিশন, ভুয়া বিল দাখিল এবং একই রিনিউয়াল কমিশন একাধিকবার দাখিল করে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই ৪ কর্মকর্তা অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টকে নিয়ম বহির্ভূত কোড নাম্বার প্রদান করে অবৈধভাবে কমিশন প্রদানের মাধ্যমে কোম্পানির বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
পাশাপাশি কয়েকটি সার্ভিসিং সেলের নামে ৭৯ লাখ ৬৭ হাজার ১২৩ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এরমধ্যে স্থানীয় সার্ভিসিং সেলের নামে ৪৮ লাখ ২৮ হাজার ৭২ টাকা, এনেক্স সার্ভিসিং সেলের নামে ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩ টাকা এবং বগুড়া শাখার সার্ভিসিং সেলের নামে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৯৫৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
এছাড়া এমএ করিম কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ৩জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভুয়া বিল দাখিল, একই বিল বারবার দাখিল, এমনকি নিজের স্ত্রীর টেলিফোন বিল গ্রহণসহ নানাবিধ খরচ দেখিয়ে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৭২৫ টাকা আত্মসাৎ করেন।
এরমধ্যে ২০১০ সালে কোম্পানির তহবিল থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৩২৫ টাকা, ২০১২ সালে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬২ টাকা এবং বিভিন্ন সময়ে আরও ৬ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৮ টাকা আত্মসাৎ করেন।
অবৈধ কমিশন ও ভূয়াবিলের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি জমি ক্রয়ের মাধ্যমেও কোম্পানির গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই কর্মকর্তারা ও সাবেক চেয়ারম্যান নাছির আলী।
এরমধ্যে ঢাকার আফতাব নগরে ২১ কাঠা জায়গা ক্রয়ের নামে সাবেক চেয়ারম্যান নাছির আলী ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। আর কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ করিম কোম্পানির সাবেক সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব শাখা) এনায়েত আলী খান, সাবেক প্রধান নিরীক্ষ ও বর্তমান সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (সুজন বিমা বিভাগ) মো. মনিরুজ্জামান খান, সিনিয়র উপ-মহাব্যবস্থাপক (পাহাড়তলী সার্ভিসিং সেল) আনিসুর রব চৌধুরী’র সহায়তায় চট্টগ্রামের ডবমুরিং থানার আকারাবাদ মৌজার আরএস খতিয়ান নম্বর ১৭৬ ও ২৫৬, আরএস দাগ নম্বর ৫০৬ ও ৫৯৭ অবস্থিত ভবনের তৃতীয় তলায় ফ্লোর কেনার নামে ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন ।
এমএ করিম ওই তিন কর্মকর্তার সহায়তায় কথিত ভবন মালিক মোহাম্মাদ আবছার আলমের নামে ২০১০ সালের ১৯ জুলাই জমি বিক্রি বাবদ কোম্পানির ৬১৩ নং ভাউচারের মাধ্যমে ৫০ লাখ ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা এবং ভবনটির কথিত আরেক মালিক ফরহাদ আলমের নামে ৬১৪ নং ভাউচারের মাধ্যমে ২ কোটি ৪১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫০ টাকা আত্মসাৎ করে। বাকি ৪১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ৬১৫ এবং ৬১৬ ভাউচারের মাধ্যমে কোম্পানি থেকে আত্মসাৎ করা হয়।
এমএ করিম ২০১০ সালের ১৮ জুলাই ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে ভবনের ফ্লোর স্পেস সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন না করেই কোম্পানির বোর্ড সভায় অনুমোদন করিয়ে নেয়। অথচ ভবনটির তৃতীয় তলা ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আরএফ প্রপার্টিজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি ও রিজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে এমএ করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ প্রতিবেদন একতরফাভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদেনর বিষয়ে আমাকে কোন কিছু অবহিত করা হয়নি।
প্রগ্রেসিভ লাইফ সূত্রে জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান বজলুর রশিদসহ একভাগে রয়েছেন শিল্পপতি আজম জাহাঙ্গীর, ইউকে প্রবাসী মিজানুর রহমান ও বাবেল মিয়া। অন্যপক্ষে রয়েছে বাকি ১০ জন পরিচালক।
আর আইডিআরএ সূত্র জানায়, আইডিআরএ কাছে প্রগ্রেসিভ লাইফের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে বর্তমান চেয়ারম্যান বজলুর রশিদ, কোম্পানি সচিব নুরুল আমিন ও সাবেক চেয়ারম্যান নাছির আলী বিরুদ্ধে বেশকিছু দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে।
এছাড়া এমএ করিম, এনায়েত আলী খান, মনিজুজ্জামান খান ও মো. রফিকুজ্জামানের দুর্নীতির অভিযোগও পেয়েছে আইডিআরএ।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৪
** বিরোধীপক্ষের প্রগ্রেসিভ লাইফ দখল
** দুর্নীতি আর দ্বন্দ্বে ডুবতে বসেছে প্রগ্রেসিভ লাইফ