ঢাকা: রাজনৈতিক সমঝোতা বাদ দিলে বর্তমান সরকার মাত্র এক বছরে সবক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে বলে দাবি করেছেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্রদীপ কুমার দত্ত। তিনি বলেন, মোট দেশজ উৎপাদন’র (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি কমানোসহ অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রের প্রবৃদ্ধিতে সরকার সফল।
সোমবার (১২ জানুয়ারি, ২০১৫) নিজ কার্যালয়ে বাংলানিউজকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় দেশের বিনিয়োগ, ব্যাংক খাত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার পাশাপাশি তুলে ধরেন ব্যাংকটির অতীত ও বর্তমান অবস্থা।
প্রদীপ কুমার বলেন, বর্তমান সরকার এক বছর পার করেছে। বছরটিতে অর্থনীতির সূচকগুলো বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রের গ্রোথ রেট (প্রবৃদ্ধির হার), মুল্যস্ফীতি, আর্থিক খাত, জিডিপি সব খাতেই মাত্র এক বছরের মতো অল্প সময়ে সরকার বিরাট সফলতা দেখিয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) খাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা বিশাল ব্যাপার। ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও আইটিতে সফলতা এসেছে। গ্রামগঞ্জে এখন ইন্টারনেট চলে গেছে। মানুষকে এই প্রযুক্তিমুখি করাটাও এক বড় ব্যাপার। এভাবে আগে কখনো হয়নি।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ কম নিয়েছেন। এ-কারণে ব্যাংকে বড় অঙ্কের তারল্য (নগদ মুদ্রা) রয়ে গেছে। দেশে সুদের হার বেশি হওয়ার কারণেবড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। তবে ফ্লাকচুয়েশনের কারণে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে ঝুঁকিও আছে।
আমরা এখন সুদের হার কমিয়ে দিয়েছি। সে কারণে এখন মানুষ ঋণের জন্য আসছে। আগে ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট রেট (আমানতের সুদ হার) অনেক বেশি ছিলো সে কারণে সুদের হারও বেড়ে গিয়েছিলো। সুদরে হার চাহিদা ও সরবরাহের উপর নির্ভর করে। সুদের হার বেশি হলে গ্রাহক টাকা নিতে আসবে না। এরই মধ্যে আমরা সুদের হার কমিয়ে দিয়েছি। সুদের হার আরও কমবে বলে আমি মনে করি।
ব্যাংকের কাছে থাকা নগদ মুদ্রার (তারল্যের)মজুত বিষয়ে এই প্রধান নির্বাহী বলেন, ব্যাংকের কাছে অধিক তারল্য থাকার কারণে ব্যাংকের মুনাফা একটু কম হচ্ছে। তবে ব্যাংক ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারছে। তারল্য উদ্বৃত্ত থাকলে ব্যাংক দেখে শুনে বিনিয়োগ করতে পারে। তারল্যে ঘাটতি দেখা দিলে ব্যাংকের অনেক ধরনের সমস্যা হয়। ব্যাংক মার্কেটে টাকা না-ও পেতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে সমস্যা হবে। ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হতে পারে। তাই আমি মনে করি তারল্য থাকলে তা কোনো ক্ষতির কারণ হবে না।
এছাড়া ব্যাংকের কাছে অধিক তারল্য থাকার একটি কারণ সরকারের নেওয়া ব্যাংকঋণের পরিমাণ কমে যাওয়া। আগে সরকারি খাত যেখানে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিতো এখন তা নিচ্ছে না। সরকারি সাবসিডিয়ারি বেশি হওয়ার কারণে অথবা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে এটি হতে পারে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ কমেনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে।
ঋণ নেওয়ার জন্য মানুষ আসছে না এমন কথাবার্তাও হচ্ছে। এধরণের অভিযোগ ঠিক নয়। তবে ঋণ নেওয়ার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয় তা হয়তো অনেকের নেই। এ-কারণে তারা ঋণ পাচ্ছেন না। আগে অনেকে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ দিতেন। এখন এটি বন্ধ হয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি অনিয়ম কেন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিল্প নগরে ঋণের পরিমাণ বেশি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা হচ্ছে শিল্পনগর। এসব নগরে শিল্পপতিরা বেশি সংখ্যায় থাকেন। এ-কারণে এসব অঞ্চলে ঋণের পরিমাণও বেশি। তবে এখন গ্রাম-অঞ্চলেও ব্যাংকের শাখা খোলা হচ্ছে। ফলে গ্রাম-অঞ্চলেও ঋণ বিতরণ হচ্ছে। ‘শহরে একটি শাখা খুলতে হলে গ্রামেও একটি শাখা খুলতে হবে’--বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে একটি নির্দেশনাও রয়েছে।
ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবের বিষয়ে প্রদীপ কুমার বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সার্বিকভাবে অর্থনীতিরই ক্ষতি হচ্ছে। হরতাল-অবরোধে দেশের ক্ষতি হবেই এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে গত ক’দিন ধরে চলা অস্থিরতা এখনো ব্যাংক খাতে তেমন বিরূপ প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু অস্থিরতা দীর্ঘ হলে পরবর্তী সময়ে কি ধরনের প্রভাব পড়ে সেটিই দেখার বিষয়। কারণ অবরোধ থাকলে, গাড়ি ঠিক মতো চলতে না পারলে, পণ্য বাজারজাত করা না গেলে, রপ্তানি-আদেশ ব্যর্থ হলে তার প্রভাব ব্যাংক খাতে পড়বে।
সিএসআর নীতিমালার বিষয়ে তিনি বলেন, আগে সিএসআর’র ক্ষেত্রে নীতিমালর বাহিরে কিছু কার্যক্রম চলতো। এ কারণেই হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে একটি নিয়মের মধ্যে এনেছে। গত বছর সরকারি ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র সোনালী ব্যাংকের সিএসআর বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করেনি। তারা আমাদের ব্যাংকের সব সিএসআর পরীক্ষা করেছে। কোনো অনিয়ম পায়নি। আমি মনে করি, সিএসআর’র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা করা খুবই ভালো উদ্যোগ।
পরিচালনা পর্ষদ চাইলেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা এমডিকে সরাতে পারবে না মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দশনার বিষয়ে প্রদীপ কুমার বলেন, বোর্ড চাইলেই এমডিকে তার পদ থেকে সরাতে পারবে না এটি একটি ভালো নীতিমালা। আমি মনে করি এ নীতিমালা ভালো উদ্দেশেই করা হয়েছে। মালিক পক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী ব্যাংক যদি কাজ করে তবে ব্যাংক চলবে না।
সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসা কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসা কমে গেছে ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। তবে দুটি ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের চেয়ে রেমিটেন্স আনার ক্ষেত্রে ভালো সফলতা দেখিয়েছে।
ব্যাংক দুটির মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে বড় বড় কিছু রেমিটেন্স আসে। তবে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি রেমিটেন্স’র পরিমাণগত দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক বেশি হলেও, সংখ্যার দিক থেকে আমাদেরও রেমিটেন্স প্রাপ্তি নয়। ইসলামী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে রেমিটেন্স বেশি আসে। সেদিক থেকেও ইসলামী ব্যাংক কিছুটা সুবিধা পায়।
আর অগ্রণী ব্যাংক সম্প্রতি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতে বেশ কয়েকটি এক্সচেঞ্জ হাউজ করেছে। এ-কারণে সিঙ্গপুর ও মালয়েশিয়া থেকে তাদের রেমিটেন্স বেশি এসেছে। সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে কিভাবে রেমিটেন্স আনা বাড়ানো যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিচ্ছি।
মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং’র বিষয়ে তিনি বলেন, আমরাও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যাবো। তবে মোবাইল ব্যাংকিং’র ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। এ কারণে আমরা এখনো মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করিনি। অনিয়ম যাতে না হয় সেসব দিক বিবেচনা করেই আমরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যাবো।
আর এজেন্ট ব্যাংকিং করতে সোনালী ব্যাংকের কোনো সমস্যা নেই। তবে এজেন্ট ব্যাংকিং ছোট ব্যাংকের জন্য সুবিধাজনক। সোনালী ব্যাংক যেহেতু অনেক বড় ব্যাংক তাই এজেন্ট ব্যাংকিং’র সুবিধা অসুবিধাগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সব বিষয় বিবেচনা করে একটি নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
** সোনালী ব্যাংকে আর জালিয়াতি হবে না
বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৪