ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

চামড়ার দামে নয়-ছয় খেলা!

রহমান মাসুদ ও মফিজুল সাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৫
চামড়ার দামে নয়-ছয় খেলা! ছবি : সোহাগ/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কোরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য নির্ধারিত দাম ঘোষণা করেছে চামড়া শিল্পের তিন ব্যবসায়ী সংগঠন। বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর ঘোষিত দাম অনুযায়ী, এবার ঢাকায় কোরবানি হওয়া গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে গরুর চামড়া ৪০-৪৫ টাকা, প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ২০-২২ টাকা, এবং বকরির চামড়া ১৫-১৭ টাকা।



কিন্তু বাস্তবে মিলছে ভিন্ন চিত্র। সংগঠন তিনটির সম্মিলিত সিন্ডিকেট এবার চামড়া নিয়ে নয়-ছয় খেলায় মেতেছে। ফলে অবশ্যম্ভাবী সংকটে পড়তে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

কোরবানির ঈদের দিন শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা, লালবাগ পোস্তার চামড়ার আড়ত, আমিনবাজার, পলাশী ও ধানমণ্ডির চামড়ার বাজার এবং হাজারীবাগের ট্যানারি ঘুরে মিলেছে চামড়া নিয়ে নানা বিভ্রান্তকর সব তথ্য।

চামড়া শিল্পের সংগঠনগুলো চামড়ার সর্বনিন্ম দাম ঠিক করে দিয়ে নিজেরাই তা মানছে না। বিভিন্ন মহল্লা ও বড় রাস্তার মোড়ে নিজেদের লোক বসিয়ে ভ্যান ও পিক-আপ থেকে চামড়া কিনছে ঘোষিত দামের দ্বিগুণ দরে। ট্যানারি মালিকরাও বিভিন্ন মহল্লায় অগ্রিম টাকা দিয়ে স্থানীয়দের দিয়েও চামড়া কিনছেন। তবে অন্যদের চাপে ফেলতে আড়ত ও ট্যানারিতে নিয়ে আসা চামড়ার ক্ষেত্রে দাম হাকছেন ঘোষিত রেট অনুযায়ী।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীতে এক শ্রেণীর মৌসুমী ব্যবসায়ী বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া কিনছেন পানির দরে। একটি বড় গরুর চামড়ার দর গৃহস্তরা পেয়েছেন আটশ’ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকা পর্যন্ত। এ প্রভাবশালী ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে চামড়া যাচ্ছে ট্যানারির ঠিক করা ফড়িয়াদের কাছে। ট্যানারির মালিকরা সেই চামড়া কিনে নিচ্ছেন ২২শ’ থেকে ২৮শ’ টাকা দিয়ে। তবে তাদের কাছে ভিড়তে পারছেন না প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ী, পোস্তার ফড়িয়া ও আড়তদাররা।

ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের অবস্থা করুণ। কেউ কেউ আগের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন।

তবে যারা শখে চামড়ার ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। কারণ, তারা এমনিতেই মহল্লা থেকে চামড়া কিনেছেন বেশি দামে। আড়তদাররা এখন সে দামে চামড়া নিতে চাচ্ছেন না। ঢাকার বাইরের চামড়া আসা শুরু হলে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের খেলায় তাদের অবস্থা আরো করুণ হয়ে উঠবে বলেই জানালেন অনেকে।

শখের বশে চামড়ায় লগ্নিকারীদের একজন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বাপ্পী। ধানমণ্ডি এলাকা থেকে শতাধিক চামড়া সংগ্রহ করেছেন তিনি। প্রতিটি চামড়া(চামড়া পণ্য ও জুতা রফতানিকারক সমিতি (বিএফএলএলএফইএ), বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এর বেঁধে দেওয়া দাম থেকে অতিরিক্ত দামে সংগ্রহ করেছেন তিনি। এখন হাজারীবাগের ট্যানারি ও পোস্তার আড়তে যে দাম হাঁকা হচ্ছে তাতে চামড়া প্রতি তার লোকসান দাঁড়াচ্ছে ৬শ’ টাকা।

মেহেদী হাসান বলেন, স্থানীয় এলাকা থেকে প্রতিটি গরুর চামড়া ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা দরে কিনতে হয়েছে। সব খরচ মিলে প্রতিটির দাম পড়েছে ২ হাজার টাকা । কিন্তু ট্যানারি মালিকেরা নিজেদের লোক দিয়ে মহল্লা থেকে বেশি দামে চামড়া কিনলেও হাজারীবাগে সে দামে কিনতে চাচ্ছেন না। এখানে দাম দিতে চান অনেক কম।

বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের ক্যাম্পাস এলাকার ৪০টি চামড়া কিনেছেন ২৪শ’ টাকা দরে। পোস্তায় নিয়ে আসার পর চামড়াপ্রতি গড়ে দাম হচ্ছে ২ হাজার টাকা। এখন চালান হারানোর শঙ্কায় আছেন তারা।

মাঠ ঘুরে দেখা গেলো কেউই নির্ধারিত রেটে চামড়া কিনছেন না। ট্যানারি মালিকরা নিজেরা রাস্তা থেকে চামড়া কিনছেন ৫০ টাকার বদলে ৮০ থেকে ৯০ টাকা বর্গফুটে। আর পোস্তার ব্যবসায়ীরা কিনছেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা বর্গফুট রেটে।

এর কারণ হিসেবে পোস্তার আড়তদার বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কম দাম নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু নিজেরা বেশি দামে চামড়া কিনে বাজারে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করেছেন। আমরা কম দাম বলি আর চামড়া পাই না। অন্যদিকে তারা তাদের লোক দিয়ে বেশি দামে চামড়া ট্যানারিতে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই আমরাও বেশি দামে কিনতে শুরু করেছি। তবে আলু পটলের ব্যবসায়ীরা (নতুন ও মৌসুমী ব্যবসায়ী) বাজারটাকে সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করেছেন। আমরা যে চামড়া ২ হাজার টাকায় কিনেছি, তারা কিনেছেন আড়াই হাজারে। এখন তারা আমাদের কাছে এলে আমরা তাদের চামড়া নিজের ক্ষতি করে তো কিনবো না।

পোস্তার আড়তদারদের সব ক্ষোভ ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে। তারা বলছেন, কম দামে বেশি চামড়া সংগ্রহ করার জন্য এবার লোক দেখানো দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ সবাই অতিরিক্ত দরে চামড়া কিনছেন।

পোস্তার আড়তদার আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি ৩০ বছর চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ট্যানারি মালিকেরা চামড়ার দাম কম নির্ধারণ করেন। অথচ তারাই অতিরিক্ত দামে চামড়া কেনেন।

তিনি আরও বলেন, আমি প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে কিনছি। এর পরে আড়তে রেখে দেবো। এতে করে দেরিতে হলেও অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনবেন ট্যানারি মালিকেরা।

তিনি বলেন, গত বছর ৬০ টাকা দর নির্ধারণ করেছিলেন ট্যানারি মালিকরা। অথচ চামড়া কিনেছেন ১২০ টাকা করে।

নগরীর আজিমপুর, পলাশী, সায়েন্সল্যাব, জিগাতলা, ধানমণ্ডি, ল্যাবএইড, আমিনবাজার ও লালবাগ পোস্তায় প্রতিটি মানভেদে গড়ে চামড়া ১৮শ’ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

পলাশীর মোড়ে অস্থায়ী ক্যাম্প করে চামড়া কিনছে জেকে লেদার ইন্টারন্যাশনাল। পোস্তার আড়তদারদের দাবি, এ ট্যানারিটি মাঠ থেকে অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনছে।

তবে ট্যানারির ‍মালিক দুলাল হোসেন বলেন, নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনছি আমরা।

চামড়া সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, ‍আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম অনেক কম। যে কারণে তারা এবার কম দাম নির্ধারণ করেছে। অথচ সংগঠনের কেউ তাদের দেওয়া আইন মানছে না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) ভাইস চেয়ারম্যান হাজী ইলিয়াসুর রহমান বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দেখে-শুনে নির্দিষ্ট দামে চামড়া কিনতে বলেছি। যারা বেশি দামে চামড়া কিনবেন, তারা ভুল করবেন। আন্তর্জাতিক বাজার রাশিয়া ও ইটালির বাজার অনেক মন্দা। যে কারণে আমাদের দেশে তার অনেক প্রভাব পড়ছে। আমার গত বছর তিন কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।

অনেকে বেঁধে দেওয়া দামের থেকে অতিরিক্ত দামে চামড়া বিক্রি করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা বেশি দামে চামড়া কিনছেন, তাদের লোকসান গুণতে হবে। অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনে তারা কোথায় বিক্রি করবেন, যারা কিনছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।

আড়তদারদের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের সব অভিযোগ সত্যি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট আলাদা। আর্ন্তজাতিক বাজারে দর পড়ে গেছে। ফলে গত ৩০ বছরকে এবারের সঙ্গে মেলালে চলবে না।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৫
আরএম/এমইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।