ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ফিরে দেখা-২০১৫

শৃঙ্খলা ফেরাতে বিমা খাতে বড় ঝাঁকুনি

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
শৃঙ্খলা ফেরাতে বিমা খাতে বড় ঝাঁকুনি

ঢাকা: গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা, অবৈধভাবে অর্থ খরচ, চেক জালিয়াতি, ভুয়া এজেন্ট, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে অযোগ্য ব্যক্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র জাল, অতিরিক্ত কমিশন নেওয়া, বাকিতে ব্যবসাসহ সকল ধরনের দুর্নীতি আর অনিয়ম হরহামেশাই চলছে বিমা খাতে। এসব দুর্নীতি আর অনিয়ম দূর করে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৫ সালে বিমা খাতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।


 
বিদায়ী বছরে অনিয়মের কারণে বাতিল করা হয়েছে একটি বিমা কোম্পানির ব্যবসার নিবন্ধন সনদ। জরিমানার কবলে পড়তে হয়েছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে। একটি কোম্পানিকেই কোটি টাকার ওপরে জরিমানা করা হয়েছে। একাধিক কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তবে এরপরও বিমা খাতে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
 
মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দক্ষ জনবলের অভাব ও উচ্চ পদে নিয়োগে অনিয়মের কারণেই বিমা খাত থেকে পুরোপুরি অনিয়ম দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বিমা কোম্পানিগুলোতে আইন লঙ্ঘন করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করা হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে অকারণেই আইডিআরএতে ফাইল আটকে রাখা হচ্ছে।
 
অভিযোগ আছে, ব্যপক অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা অধিদফতর বিলুপ্ত করা হয়। এরপর ২০১১ সালে গঠন করা হয় নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কিন্তু দুর্নীতির কবল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিও।
 
নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থায় বার বার দুর্নীতিপরায়ন ও অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো তেমন কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি সংস্থাটি। ক্ষেত্রবিশেষে আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
 
এমনকি বর্তমান দায়িত্বে থাকা ৪ জন সদস্যের মধ্যে দু’জনের যোগ্যতা নিয়ে বিমা খাতে নানা গুঞ্জন রয়েছে। এ দুই সদস্যকে বিমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের কেউ কখনো কোনো বিমা কোম্পানির শীর্ষ পদে চাকরি করেননি।
 
তাদের মধ্যে একজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ওই সদস্য সাধারণ বিএ পাস। অথচ বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা হয়েছে মাস্টার্স পাস।
 
এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ থাকা একজনকে সম্প্রতি আইডিআরএ’র উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর নিরীক্ষা প্রতিবেদন এ উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে। তিনি অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে প্রগ্রেসিভ লাইফ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাত করেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলাও করা হয়েছে।
 
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের লোকবলের সংকট রয়েছে। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সঠিক সময়ে সব কাজ করা সম্ভব হয় না। তারপরও বিমা খাতকে আমরা নিয়মের মধ্যে আনতে কাজ করে যাচ্ছি।
 
তিনি বলেন, বিমা খাতের উন্নয়নে ও গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় আইডিআরএ থেকে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণেও আইডিআরএ পিছপা হবে না। ইতোমধ্যে গুরুতর অনিয়মের কারণে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ বাতিল করা হয়েছে। ৬টি জীবন বিমা কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি সাধারণ বিমা কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের জরিমনা করা হয়েছে।
 
বিমা খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলানিউজের ১০টি বিমা কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে তাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। তারা বলেন, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন বাতিল করা আইডিআরএ’র একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে আইডিআরএ এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষে স্বজনপ্রীতিও ঘটছে।
 
গৃহদ্বন্দ্বে আইডিআরএ
২০১১ সালে আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। প্রথম ধাপে নিয়োগ দেওয়া সদস্যদের বিদায় করে দেওয়ার পরও এ দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছে।
 
নেই আইনের প্রবিধান
বিমা আইন পাসের পর একে একে ৫টি বছর পার হলেও তৈরি করা হয়নি আইনের অধিকাংশ বিধি ও প্রবিধানমালা। গত ৫ বছরে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৯টি প্রবিধানমালা। আর এখনো আলোর মুখ দেখেনি ১৭টি বিধি ও প্রবিধানমাল। অথচ এ বিধি ও প্রবিধানমালা হলো আইনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ বিধি ও প্রবিধানমালা ছাড়া আইন মূলত অকার্যকর।
 
পাঁচ বছরেও লোকবল নিয়োগ হয়নি
বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের পর ৫ বছর কেটে গেলেও এখনো সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী আইডিআরএতে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে আইডিআরএ’র জনবল কাঠামো অনুমোদন করা হয়। কিন্তু এরপর ১০ মাস পার হয়ে গেলেও তার বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ভাড়া করা (চুক্তিভিত্তিক) লোকবল দিয়েই চলছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
 
কোম্পানির সনদ বাতিল
অনিয়মের অভিযোগ স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ বাতিল করেছে করেছে আইডিআরএ। ফলে প্রতিষ্ঠানটি দেশে আর কোনো বিমা ব্যবসা করতে পারবে না। পুনঃবিমায় অনিয়ম করার কারণে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন সনদ বাতিল করে আইডিআরএ।
 
কোটি টাকার অবৈধ ব্যয়
সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশনসহ ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানি শেষ বছরে ৩০৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা অবৈধভাবে খরচ করেছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে এ অবৈধ ব্যয় করা হয়।
 
এর আগের পাঁচ বছরে একইভাবে ১ হাজার ৪৭৮ কোটি ১ লাখ টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ শেষ ৬ বছরে দেশের জীবন বিমা কোম্পানিগুলো অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৭৮৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
 
ছয় কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ
আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকদের টাকা খরচ করায় ২০১৫ সালে ৬টি জীবন বিমা কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ করেছে আইডিআরএ। এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশনসহ আছে পদ্মা ইসলামী লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, মেঘনা লাইফ, প্রগতি লাইফ ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি।
 
গ্রাহকের চেক জালিয়াতি
বিমা পলিসির মেয়াদ শেষে বিমা দাবি পরিশোধ অথবা গ্রাহকের মৃত্যুজনিত বিমা দাবির টাকা পরিশোধে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো হরহামেশাই টালবাহানা করছে। দিনের পর দিন কোম্পানিতে ধরনা দিয়েও গ্রাহকরা তার পাওয়া না পাওয়ার বিষয়ে বাংলানিউজে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে গ্রাহকদের বিমা দাবির চেক জালিয়াতি। মেঘনা লাইফের গ্রাহকের চেক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বিদায়ী বছরে।
 
কোটি টাকার জরিমানা
অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া ও বাকি ব্যবসার অভিযোগে ২০১৫ সালে আইডিআরএ ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সকে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। এছাড়া বছরটিতে ৩ লাখ থেকে ৪৭ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে আরও ২৭টি কোম্পানিকে।
 
কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে- স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল, এশিয়া, রিপাবলিক, ইস্টল্যান্ড, ইসলামী কমার্শিয়াল, ইউনাইটেড, রূপালী, সেন্ট্রাল, সোনার বাংলা, নিটল, ক্রিস্টাল, পিপলস, গ্রীণ ডেল্টা, পাইওনিয়ার, অগ্রণী, গ্লোবাল, প্রাইম, কন্টিনেন্টাল, প্যারামাউন্ট, রিলায়েন্স,  বাংলাদেশ জেনারেল, সিটি জেনারেল, মার্কেন্টাইল, তাকাফুল ইসলামী, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ এবং জনতা ইন্স্যুরেন্স।
 
মাসের পর মাস ফাইল আটক
মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনসহ বিভিন্ন ধরনের ফাইল মাসের পর মাস আটকে থাকে আইডিআরএ’র কার্যালয়ে। এমনকি ১৫ দিনের মধ্যে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদনের সিদ্ধান্ত জানানোর কথা থাকলেও কয়েক মাস আগে করা বেশ কয়েকটি আবেদন বর্তমানে পড়ে আছে।
 
পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে জরিমানা
বিদায়ী বছরে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের কারণে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের সকল সদস্যকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে উদ্যোক্তা পরিচালক, নিরপেক্ষ পরিচালক ও শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক হিসেবে মোট ২০ জন পরিচালক রয়েছেন। তাদের মধ্যে শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক ৪ জন ও নিরপেক্ষ পরিচালক ৪ জন। তবে বিমা আইন অনুযায়ী একটি কোম্পানিতে দু’জনের বেশি নিরপেক্ষ পরিচালক থাকতে পারবেন না।
 
সিইও পদে অনিয়ম
প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকার পরও অর্থমন্ত্রীর বাল্যবন্ধুর মেয়ে হওয়ার কারণে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সিইও পদে নিয়োগের অনুমোদন পেয়েছেন ফারজানা চৌধুরী। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বহাল তবিয়তে প্রতিষ্ঠানটিতে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
এএসএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।