কলকাতা: বিদেশ থেকে ছেলের ‘রেমিটেন্স’ পাঠানোর সময় হয় গেছে। তাই বারবার ডলারের দামের খোঁজ নিচ্ছেন রমেন বাবু।
কারণ তিনি ফ্রি-ল্যান্সর হিসেবে বিদেশ থেকে আসা আইটি’র বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। অথবা বিদেশ যাত্রার খরচ, তারও মূল্য নির্ধারণ করতে হবে সেই ডলার দিয়ে।
শুধু রমেন বাবু আর সোহেল একা নন, আমদানি রপ্তানির ব্যবসা করেন, বিদেশ যাত্রা করতে চলেছেন কিংবা বিদেশি সংস্থায় চাকরি করেন এ ধরনের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন তাকিয়ে থাকেন ডলারের দামের দিকে।
শুধু আমজনতা কেন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সমস্ত দেশের সরকার, সবাই তাকিয়ে থাকে ডলারের দামের দিকে। এমন কি বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দামের ওঠা-নামার বিষয়টিকেও ডলারের দামের পরিপ্রেক্ষিতে ধরা হয়।
ভারতের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, ভারতের অর্থনীতির বড় অংশ ডলারের দামের উপর প্রভাবিত হয়। ভারতের শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে, বিদেশ থেকে তেল আমদানি, ভারতের আইটি কোম্পানিগুলির ব্যবসা, সোনার দাম, সমস্ত বিষয় ডলারের দামের ওঠা-নামার উপর প্রভাবিত হয়।
বর্তমানে বাজারে টাকার অঙ্কে ঠিক এ রকম, ১০০ ইউরোতে পাওয়া যায় প্রায় ১১১.২৩ ডলার। অর্থাৎ ইউরোর দাম ডলারের থেকে বেশি। আবার ১ পাউন্ডে পাওয়া যায় প্রায় ১.৪৩ ডলার। অর্থাৎ পাউন্ডের দাম ডলারের থেকে কিছুটা বেশি। অন্যদিকে ১ ডলারে পাওয়া যায় প্রায় ৬৩.৪৯ রুপি এবং ১ ডলারে পাওয়া যায় প্রায় ৭৮.৪২ টাকা। এর অর্থ রুপি এবং টাকার থেকে ডলারের দাম বেশি।
কিন্তু ডলার এহেন মহা শক্তিমান হয়ে উঠল কি করে?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে, নজর দিতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ের দিকে। সেই সময় থেকেই ডলার ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে স্থান করে নেয়। এমনকি ইউরো কিংবা ব্রিটিশ পাউন্ডের তুলনায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ কিছুটা খারাপ হয়ে পড়ে। ধাক্কা আসে এশিয়ার অর্থনীতিতেও। সময়টা ১৯৪৪ সাল। এ সময় অবস্থা সামাল দিতে মাঠে নামে ‘বিশ্ব ব্যাংক’। ঠিক হয়, এক আউন্স সোনার দাম হবে ৩৫ ডলার। এখান থেকেই শুরু।
ইউরোপের পূর্ণ নির্মাণে এ সময় ‘মার্শাল প্ল্যান’ বলে বিখ্যাত একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এ পরিকল্পনায় ইউরোপিয়ান দেশগুলিকে ডলার সাহায্য দেওয়া হয়। এটাই ছিল ডলারের উত্থানের দ্বিতীয় কারণ।
তৃতীয় কারণটি আরও জোরালো। আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবে সবার আগে নিজের জায়গা করে নেয়।
কাঁচা তেল বা জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে ডলারের দামের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকা তেলের অন্যতম বড় আমদানিকারক। ফলে ডলারের দাম বাড়া-কমার সঙ্গে তেলের দামেরও হেরফের হয়। এটিও একটি কারণ ডলার শক্তিমান হওয়ার।
এ সবক’টি ঐতিহাসিক কারণ। এ কারণগুলির ফলে ডলার বিশ্ব অর্থনীতিতে তার জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। কিন্তু এ দীর্ঘদিনের শক্তপোক্ত অবস্থান ছাড়াও আরও তিনটি প্রধান কারণ আছে, ফলে ডলার বর্তমান সময়েও এতটা শক্তিশালী।
এর একটি কারণ এখনও পর্যন্ত ডলার যে কোন কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যতম নির্ভরযোগ্য সম্পদ। অর্থাৎ অন্য কোন মুদ্রা, সোনা বা শেয়ার তার দাম অস্বাভাবিক ভাবে পড়তে উঠতে পারে। কিন্তু সেই তুলনায় ডলার অনেকটাই স্থিতিশীল। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে ডলার সব থেকে বেশি ছাপা হওয়া মুদ্রার মধ্যে একটি।
অপর কারণ, পৃথিবীতে ডলার ব্যাপকভাবে অন্য দেশের মুদ্রা এবং পণ্যের লেনদেনে ব্যবহার করা হয়। এর পরের কারণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডলার এমন এক মুদ্রা যেটিকে কেনাবেচা করার জন্য বাজারটি যথেষ্ট সংগঠিত। ফলে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মানুষই ডলার কেনাবেচা করতে পারেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক কমেডিটি বাজারে ডলারের মাধ্যমেই কেনাবেচা করা হয়।
এছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। আছে বেশ কিছু জটিল অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা। সেই জটিল ব্যাখ্যার দিকে না গিয়েও বলা যায় আজকের দুনিয়ায় এ কারণগুলির জন্য ডলার এতটাই শক্তিশালী।
অতএব এখন থেকে মাঝেমাঝে হিসেব করে নেবেন আপনার জমা টাকা কিংবা সম্পত্তি ডলারের হিসেবে কত। আর ডলারের ওঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে সেটা কতটা বাড়ল বা কমলো। বিদেশে গিয়ে অবশ্যই ডলার ভাঙানোর আগে যাচাই করে নেওয়া উচিত ডলারের ওই দিনের দাম ঠিক কতো।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৬
ভিএস/আরএ