ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

চীনা ঘড়ি আমদানিতে ছাড়, দেশীয় ঘড়িতে শুল্কের খাড়া!

রহমত উল্যাহ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
চীনা ঘড়ি আমদানিতে ছাড়, দেশীয় ঘড়িতে শুল্কের খাড়া! ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: দেড়শ’ টাকার চীনা ঘড়ির ধাক্কায় সকল সম্ভাবনা নিয়েও বিপাকে পড়ে থাকছে দেশীয় ঘড়ি শিল্প। গুনে ও মানে অনেক ভালো হওয়া সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ও মুনাফালোভী আমদানি চক্রের কারণে এই শিল্পটি ত্রিশ বছর ধরে ধুকছে।

 

৮০’র দশক থেকেই দেশে তৈরি হচ্ছে দেওয়াল ঘড়ি ও হাত ঘড়ি। সামান্য পুঁজি ও স্বল্প শ্রমে এই শিল্পটি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাজার সয়লাব হয়ে থাকছে চীনা সস্তা ঘড়িতে।  

সংশ্লিষ্টরা জানালেন, মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজিতে হওয়া যায় এই ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা। হাত বাড়ালেই মিলবে কাঁচামাল। স্রেফ মেশিনটি আমদানি করে আনলে দেশেই তৈরি সম্ভব ফ্যাশন্যাবল ঘড়ি।  যার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।  

কেবল দেশের চাহিদা মেটানোই নয়, সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশে তৈরি ঘড়ি ইউরোপ আমেরিকাতেও রপ্তানি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।  

বাংলাদেশ ওয়াচ ইম্পোটার্স, এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম কাউছারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এ শিল্পকে কুটির শিল্প ঘোষণা, সরকারের অগ্রাধিকার খাত দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ কয়েকটি দেশে রফতানির দ্বার উম্মোচিত হবে।  

এর পাশাপাশি বিদেশ থেকে, বিশেষ করে চীন থেকে যে হারে ঘড়ি আমদানি হচ্ছে তা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তিনি। বললেন, আমদানি শুল্ক বাড়ালে এটা সম্ভব হতে পারে।  

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হরলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (ঘড়ি বিষয়ক) ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকলেও আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।  

৮০’র দশক থেকে বাংলাদেশে হাত ঘড়ি ও দেওয়াল ঘড়ি তৈরি হচ্ছে। ছোট্ট একটি ঘরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তৈরি করা যায় নানন্দিক দেওয়াল ঘড়ি। মেশিনটি ছাড়া সব কাঁচামালই বাংলাদেশি।  
চীন, জাপান ও সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি হয় ঘড়ির মেশিন। রাজধানীর পুরান ঢাকার কয়েকটি জায়গায় তা বিক্রি হয়।  

এসব মেশিন কিনেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঘড়ি বানান। তাদের হাতেই রাজধানীর ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগসহ ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের দেওয়াল ঘড়ি।  

এম কাউছারুজ্জামান বলেন, দেশে তৈরি এসব ঘড়ির প্রতিটি দুইশ’ টাকায় বিক্রি করা যায়। কিন্তু চীন থেকে আমদানি করা একটি ঘড়ি বিক্রি হচ্ছে মাত্র দেড়শ টাকা। তবে সেসব ঘড়ি অত্যন্ত নিম্নমানের।

এছাড়া ভ্যাট নিয়েও এই খাতের উদ্যোক্তাদের পোহাতে হয় বাড়তি ঝামেলা। দেশে তৈরি দেওয়াল ঘড়ি বাজারজাতে দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। তাছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদের হয়রানিতো রয়েছেই।  

ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন উদ্যোক্তারা।  

কাউছারুজ্জামান জানান, পাশের দেশ ভারতেও বাংলাদেশের দেওয়াল ঘড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এক সময় মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরায় প্রচুর ঘড়ি রফতানি করতেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। কিন্তু নন ট্যারিফ ব্যারিয়ারের (শুল্ক বহির্ভূত বাধা) কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে।  

দেশীয় উদ্যোগকে শুল্ক বাধায় ফেললেও চীন থেকে আমদানিকে সহজ করে দিয়েছে সরকার। এক সময় চীন থেকে দেওয়াল ঘড়ি আমদানিতে আড়াইশ থেকে তিনশ’ শতাংশ শুল্ক থাকলেও বর্তমানে তা করা হয়েছে ১৫ শতাংশ।  

এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণায় আনছেন কোটি কোটি টাকার ঘড়ি। ফলে সেসবের ধাক্কায়, অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে।

দেশে এসব শিল্প উদ্যোক্তারা প্রতিমাসে অন্তত এক লাখ দেওয়াল ঘড়ি তৈরি করছেন। তবে চাহিদা রয়েছে কয়েক লাখ ঘড়ির। সরকার নজর দিলে দেশের চাহিদা দেশীয় শিল্পেই মেটানো সম্ভব।  

স্বল্প পুঁজির এ ব্যবসার এ খাতে সরকার ভ্যাটমুক্ত ও কুটির শিল্প ঘোষণা করলে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, রফতানিতে অর্জিত হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও।  

ইউরোপে রফতানির সম্ভাবনা তুলে ধরে কাউছারুজ্জামান বলেন, জিএসপি’র শর্ত অনুযায়ী ২৫ শতাংশ দেশীয় কাঁচামাল হলে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। মেশিন ছাড়া ঘড়ির সব কাঁচামাল দেশীয়। সরকার উদ্যোগ নিলে যেসব তরুণ ব্যবসায়ী ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে কাজ করে তারা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে।

অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, ভারতে ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার রয়েছে। আর ভারতও রফতানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করছে। এছাড়া রফতানি সনদও বেশ জটিল করেছে দেশটি।  

চকবাজার এলাকার দেওয়াল ঘড়ি তৈরির উদ্যোক্তা মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাবা খলিলুর রহমান এ ব্যবসা করতো। আমিও করছি। অল্প পুঁজি লাগে। বেশ লাভ হতো। এখন দোকানে আর ঘড়ি নিতে চায় না। কারণ আমাদের তৈরির ঘড়ির দাম কিছুটা বেশি। ’ 

হাতঘড়ি সম্পর্কে কাউছারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, দেশে বছরে প্রায় ১০ লাখ হাত ঘড়ির চাহিদা রয়েছে। চীন থেকে যন্ত্রাংশ এনে এখানে সংযোজন করা হয়। ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, সাভার, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ছোট ছোট কারখানা। হাত ঘড়িও ভ্যাটের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

তিনি আরও বলেন, সংযোজন করা হলেও বাংলাদেশি এসব ঘড়ির মান আমদানি করা ঘড়ির চেয়ে অনেক ভালো। প্রতিটি ঘড়ি পাঁচ থেকে সাতশ’ টাকার মধ্যে পাওয়া সম্ভব। আর আমদানি করা ঘড়ি হাজার টাকার বেশি। হাত ঘড়ি ভারতসহ কয়েকটি দেশে বেশ চাহিদা রয়েছে। এছাড়া দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এসব ঘড়ি অত্যন্ত জনপ্রিয়।  

তবে দেশে তৈরি হাত ঘড়িতেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। অথচ আমদানিতে শুল্ক অত্যন্ত কম।  

দেওয়াল ও হাত ঘড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে জানান কাউছারুজ্জামান।  

অল্প পুঁজির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রফতানিতে শিল্পটি সম্ভাবনাময় বলেই মনে করেন তিনি।  

তিনি বলেন, সুইজারল্যান্ড, চীনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেক হরলজিক্যাল ইনস্টিটিটিউট (ঘড়ি বিষয়ক) ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে তরুণদের ঘড়ির ডিজাইনসহ ঘড়ি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। করা হয় চাহিদা অনুযায়ী গবেষণা। আমাদের দেশে এ ধরনের ইনস্টিটিউট এখন সময়ের দাবি।

সরকার ও বেসরকারি খাতে এ ধরণের উদ্যোগ নিলে অনেক ফ্যাশন ডিজাইন হাউজ ঘড়ি রফতানি করতে পারবে। এ খাতে নজর দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই ঘড়ি ব্যবসায়ী।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
আরইউ/এএটি/পিসি/এমএমকে
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।