ঢাকা: সাভারের রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮ শতাংশ শ্রমিক এখনও বেকার। আহত শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে এখনও কাজে ফিরতে পারছেন না।
সম্প্রতি রাজধানীর ব্রাক সেন্টার ইন-এ অ্যাকশনএইডের প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। ‘রানা প্লাজা ধসের তিন বছর: পোশাক শিল্পের অগ্রগতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বর্তমান পরিস্থিতি এবং পোশাক খাতের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবিরের সঞ্চালনায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টর জেনারেল সাইদ আহমেদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) প্রকল্প ব্যবস্থাপক টপো পুটিয়ানেন, পোশাক খাতের উন্নয়নে গঠিত মার্কিন ক্রেতাদের সংগঠন ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ রবিন।
এছাড়া রানা প্লাজার ভুক্তভোগী শ্রমিক রফিক খান ও নাজমা আক্তার আলোচনায় অংশ নেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন রাইট টু জাস্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক গর্ভন্যান্স-এএবি’র ম্যানেজার নুজহাত জেবিন।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের প্রায় ৭৯ শতাংশ নিজে ব্যবসা করে বাঁচতে চান এখন। মাত্র ৫ ভাগ শ্রমিক পোশাক শিল্পে ফের কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। অর্থাৎ অধিকাংশ শ্রমিকদের মধ্যে কারখানায় কাজ করার ভীতি কাজ করছে।
প্রতিবেদনটি ১৩০০ জন আহত এবং ৫০০ জন নিহত শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ এর মধ্যে।
প্রতিবেদন বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের ২০ ভাগেরই পরিবারে দুইজন করে নির্ভরশীল সদস্য আছে। ২৩ ভাগের আছে ৪ জন করে নির্ভরশীল সদস্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, এখন ওই শ্রমিকরা যে আয় করেন, তার ৬১ ভাগ চলে যায় খাবারে। আয়ের প্রায় ১৬ ভাগ যাচ্ছে ঘর ভাড়ায়। তারা মাত্র ৮ ভাগ টাকা খরচ করতে পারেন চিকিৎসার ক্ষেত্রে। যদিও এই ক্ষেত্রে টাকাটা বেশি দরকার ছিল, আবার কাজে ফিরতে।
অনুষ্ঠানে শ্রমিক নাজমা আক্তার বলেন, আমি ফ্যান্টম ফ্যাক্টরিতে ৫ তলায় কোয়ালিটি সুপারভাইজর হিসেবে কাজ করতাম। বিদ্যুৎ চলে যাবার পর শব্দ হলো। সব ভেঙে পড়ল। শরীরে প্রচণ্ড আঘাত পাই। ধসের তিনদিন পর আমি উদ্ধার হই।
তিনি বলেন, এখন আর গার্মেন্টসে ফিরে যেতে চাই না। সেই ঘটনা আমি আর ভুলতে পারি না। ঘটনার পর আমি তিন ধাপে টাকা পেয়েছি। প্রথমে ৫০ হাজার, পরে ৩৫ হাজার এবং শেষে ৬০ হাজার। সর্বশেষ টাকা পেয়েছি দুই সপ্তাহ আগে। এই টাকা বেশি কাজে লাগাতে পারিনি। কারণ যখন প্রয়োজন ছিল তখন পাইনি। এখনও আমার মাথায় আঘাত কাটিয়ে উঠিনি। চিকিৎসা এখনও শেষ করতে পারিনি।
শ্রমিক রফিক খান কাজ করতেন রানা প্লাজার ইথার টেক্সস্টে। তিনি অনুষ্ঠানে বলেন, আমি ষষ্ঠ তলায় কাজ করতাম। ধসের ৯ মাস আগে আমি সেখানে কাজে যোগ দিই। প্রতিদিনের মত সেদিনও কাজে যাই। ধসের ১৯ ঘণ্টা পর আমি উদ্ধার হই। উদ্ধারের পর আমাকে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চিকিৎসা করানো হয়। তবে সেই চিকিৎসা সেভাবে কাজে লাগেনি। আমি এখনো ঠিকমত হাটতে পারি না। এখন আমি নিজের টাকায় চিকিৎসা নিচ্ছি।
তিনি জানান, সাভারে কিছু প্রশিক্ষণ পেয়েছি। সেটা দিয়ে একটা দোকান দিয়েছি। এখন আর গার্মেন্টসে কাজ করতে চাই না। কারণ সেখানে কাজ করার ইচ্ছা আমার নাই। প্রথম প্রথম অনেকেই যোগাযোগ করতো। এখন কোনো মালিক বা ব্র্যান্ড, কারও সঙ্গে যোগাযোগ নাই। নানা সময়ে কিছু টাকা পেয়েছি। তবে সেটা বেশি কাজে লাগাতে পারিনি।
অ্যাকশনএইডের প্রতিবেদনে ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ দিতে মালিক, ক্রেতা, সরকার নানা সময় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রেতারা যে টাকা দেওয়ার কথা বলেছে, তারা বলেছে সেটা দেওয়া হয়ে গেছে। তবে শ্রমিকরা যে টাকা পেয়েছে, সেটা আসলে তাদের কাজে আসছে না। ক্ষতিপূরণে শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করে বলা হয়, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন মানদণ্ডে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলো এটা এখনও শ্রমিকদের কাছে পরিষ্কার নয়। রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম আইন সংশোধন একটি বড় ঘটনা। কিন্তু এখনও বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন দরকার। বিশেষ করে শ্রমিক কর্তৃক অসৎ আচরণের সংজ্ঞা, ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়াদি স্পষ্ট করা দরকার। আর মালিকপক্ষকে অবহিত করা এবং ফ্যাক্টরির বাইরের কেউ ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে না, এসব বিষয় মুক্ত সংগঠন চর্চার পরিপন্থী।
২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত রেজিস্ট্রিকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৪৬৪, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেশ ইতিবাচক। এখন দেখার বিষয়, এই সংগঠনগুলো কতটা স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করছে, আর অন্য ফ্যাক্টরিগুলো এই সুযোগ পাচ্ছে কিনা।
২০১৩ সালের ওই দুর্ঘটনার পর আরেকটি বড় ইস্যু হলো নিরাপদ কর্মক্ষেত্র। অ্যালায়েন্স, অ্যাকর্ড, ত্রি-পক্ষীয় কমিটির এরকম অনেক উদ্যোগ দৃশ্যমান। প্রশ্ন হলো এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অর্থায়নের মূল দায়িত্ব নেবে কে? এবং ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের ফলে যেসব ত্রুটি ধরা পড়েছে, তা কতো সময়ের মধ্যে সমাধান করা হবে?
অনুষ্ঠানে ড. হামিদা হোসেন বলেন, শ্রমিকরা যা পেয়েছে বা পাচ্ছে তাকে আসলে ক্ষতিপূরণ বলা যাবে না। এখন আইনে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার কথা বলা হয়েছে। আইনি কিছু জটিলতা আছে। শ্রমিকরা যে শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়েছেন, তাতে তাদের দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা জরুরি। আর এর সঙ্গে দায়বদ্ধতা জড়িত। এখন শ্রমিকদের উন্নয়নে নানা কাজ করা হচ্ছে, তবে তার সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শ্রমিকদের জন্য যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে সেটা পূর্ণাঙ্গ নয়। তাদের কর্মসংস্থান, পুনর্বাসনের জন্য যা করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
ফারাহ্ কবির বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ, নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ নিয়ে বিভিন্নভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে গবেষণার ফলাফল আমাদের আশাবাদী করছে না। আমাদের কাজ ও উদ্যোগগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে না পারলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। তিন বছর পার হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের যা দেওয়া হয়েছে সেটা আর্থিক সহযোগিতা। ক্ষতিপূরণ বললেই শ্রমিকের মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক বিষয়গুলোকে নিয়ে কাজ করতে হবে। এখানে কাজ করতেই হবে। আর এজন্য সমন্বয়টা খুবই জরুরি। আমরা আরেকটা রানা প্লাজা দেখতে চাই না।
টপো পুটিয়ানেন বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও গার্মেন্ট স সেক্টরের উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। দেখা গেল সরকার, মালিক, ক্রেতারা নানা দিক দিয়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন, যার আইনি বা প্রতিষ্ঠানিক কোনো ভিত্তি নেই। ভবিষ্যতে যেন রানা প্লাজার মত দুর্ঘটনা না ঘটে, সেজন্য যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
এসএম/এইচএ/