বেনাপোল (যশোর): দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল যশোরের প্রায় সবখানে এবার ধানের বাম্পার ফলন হলেও ভারতীয় চাল আমদানির প্রভাবে নায্যমূল্য না পাওয়ায় হাসি নেই ধান চাষিদের মুখে। বাধ্য হয়ে কম মূল্যে ধান বিক্রি করেও নগদ টাকা না পাওয়ায় অনেক চাষিই জমিতে পরবর্তী চাষের কাজ এখনও শুরু করতে পারেননি।
ভারতীয় চাল আমদানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আড়তদার ও চাল প্রস্তুতকারী চাতাল ব্যবসায়ীরাও। তাদের অভিযোগ দেশে বর্তমানে উৎপাদিত ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় চালে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশীয় বাজার। এতে চাতাল ও আড়তে অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান ও চাল।
এ অবস্থাতে ক্রয়কৃত ধান থেকে চাল উৎপাদন করে বর্তমানে প্রতি কেজিতে চাতাল মালিকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। অবিলম্বে সককারকে ভারতীয় চাল আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন চাষি, চাতাল মালিকসহ সংশিষ্টরা।
বেনাপোল সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় কারও আড়তের গুদাম ঘরে-আবার কারো চাতালে অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান ও চাল। এতে লোকসানের বোঝা বইতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের।
কম শুল্কে ভারতীয় চাল আমদানির সুযোগ থাকায় এক শ্রেণির মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা এখনও ভারতীয় চাল আমদানি করে যাচ্ছেন। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ চাষিদের।
জানা যায়, শুল্কমুক্ত অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানি হতো। সম্প্রতি সরকার ভারতীয় চাল আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহী করতে প্রথমে ১০ শতাংশ ও পরে ২০ শতাংশ হারে শুল্ককর বসিয়েছে। কিন্তু এতেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে এখনও চাল আমদানি অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ০৯ মে পর্যন্ত ৪ মাস ৯ দিনে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে ১০ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে।
চলতি মাসের ০৯ তারিখে বেনাপোলের আমদানি কারক লিপু ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভারত থেকে ১শ’ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। পণ্যটি ছাড় করেছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রূপালী এন্টারপ্রাইজ। প্রতি মেট্রিক টন চাল ৩,৯০০ মার্কিন ডলার মূল্যে আমদানি করা হয়। একই দিন ফরিদপুরের জয়দুর্গা ভাণ্ডার নামে আরেক আমদানিকারকের নামে ৬৮ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে এই বন্দর দিয়ে। বন্দর থেকে চাল ছাড়াতে আমদানি মূল্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
লিপু ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি নিপু হোসেন বাংলানিউজকে জানান, দেশের বাজারে ভারতীয় চালের চাহিদা থাকায় তারা চাল আমদানি করছেন। তবে বর্তমানে যে দরে চাল আমদানি করা হচ্ছে তাতে তারা লোকসানে আছেন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কোনরকমে আমদানি করছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
বেনাপোল বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা যায় ভারত থেকে মিনিকেট, স্বর্ণা, মুড়ি তৈরির চাল ও পোলাও চালসহ বিভিন্ন প্রকারের চাল আমদানি হচ্ছে।
যশোরের শার্শা উপজেলার ঘিবা গ্রামের চাষি বিপ্লব হোসেন জানান, সব মিলিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১১ হাজার টাকা। বাজারে সেই জমির ধান বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার ২শ’ টাকায়। লাভ তো দূরের কথা প্রতি বিঘায় কৃষকদের লোকসান হচ্ছে ৮শ’ টাকা। তারপরেও কম মূল্যে ধান বিক্রি করে পাওনা টাকা হাতে আসছে না। মহাজনরা বলছেন তারাও বিক্রি করা ধানের দাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানি তাদের জন্য মরণঘাতী বলে জানান তিনি।
শার্শা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া বাজারের চাল উৎপাদনকারী চাতাল ব্যবসায়ী ভাই ভাই ট্রেডার্সের মালিক আব্দুল রাজ্জাক জানান, তার মিলে প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক চাল উৎপাদনের কাজ করতেন। বর্তমানে ভারতীয় চালের প্রভাবে ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। এতে শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারায় তারা অনেকে কাজে আসছেন না। এখনও তার চাতালে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন ধান ও চাল অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু বিক্রি হলেও দাম হাতে না পাওয়ায় তিনি চাষিদেরও দাম মিটাতে পারছেন না।
আব্দুল রাজ্জাকের অভিযোগ ভারত থেকে চাল আমদানি অব্যাহত থাকায় তাদের উৎপাদিত চাল বাজারে নায্য মূল্য পাচ্ছে না। নতুন ধান ওঠার সময় সরকারকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে ভারতীয় চালের আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
শার্শা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন বলেন, বেশকিছু দিন হলো ধান ঘরে উঠেছে। জমিতে পরবর্তী ফসলের চাষ করতে হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ধান বিক্রি করতে পারিনি। এতে হাতে টাকা না থাকায় আবাদি জমি পড়ে আছে, অন্য চাষ শুরু করতে পারছি না। সরকার ন্যায্য মূল্যে ধান-চাল কিনবে শুনেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোদিন সরকারের কাছে ধান বেচতে পারিনি। সরকার ধান কেনে ডিলার, মিল মালিক ও ফরিয়াদের কাছ থেকে। কৃষকরা কখনও তাদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্য পায় না।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক জানান, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণের ওপর সংশিষ্ট দপ্তরের আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে দেখা যায় সেখানে কোনো পণ্যের উৎপাদন বেশি হলে তারা বাইরের দেশ থেকে একটি সময় বেঁধে দিয়ে আমদানি বন্ধ করে দিয়ে রফতানির ওপর গুরুত্ব দেয়। আবার ওই পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে তখন আমদানি বন্ধের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বাংলাদেশেও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস কার্গো শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্ত জমির উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, ২০ শতাংশ শুল্ক মূল্য পরিশোধে ভারতীয় চালের আমদানি অব্যাহত আছে। তবে বর্তমানে চাল আমদানি পূর্বের তুলনায় কমেছে।
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিরক কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, এবার উপজেলাতে ২১, ৫৮০ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু চাষিরা অন্য চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়ায় ২০,১০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ওই কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, সরকার ৯২০ টাকা মণ দরে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি মাসের ০৫ মে থেকে ধান কেনার কথা থাকলেও এখনও পর্যন্ত তা শুরু হয়নি।
সরকারিভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা এখনও শুরু না হওয়ায় বাধ্য হয়ে চাষিরা প্রয়োজন মেটাতে কম মূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করছেন।
শার্শা উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার দাস বুধবার (১৮ মে) দুপুরে বাংলানিউজকে জানান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাকে কৃষকদের তালিকা না দেওয়ায় তিনি ধান সংগ্রহ শুরু করতে পারছেন না।
এদিকে কৃষি কর্মকর্তা হিরক কুমার সরকার বলছেন, চাষিদের তালিকা এখনও প্রস্তুত হয়নি।
শার্শা উপজেলার ধলদা গ্রামের চাষি হাশেম আলী জানান, সারা বছর সংসার চালাতে ও চাষাবাদের কাজে তাকে দেনা করতে হয়। নতুন ফসল ঘরে তোলার সাথে সাথে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধের চাপ আসে। এ সময় ধানের পরবর্তী চাষের জন্যও হাতে টাকার প্রয়োজন হয়। এবার নতুন ধান ঘরে উঠে মাস পেরোতে যাচ্ছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকার নায্য মূল্যে ধান ক্রয় শুরু করেনি। তাই দেনা পরিশোধ ও জমিতে অন্যান্য ফষল চাষের জন্য তাকে বাধ্য হয়ে আগেই কম মূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রিয় করতে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ ওঠেনি। সরকার যদি ধান ওঠার শুরুতেই নায্য মূল্যে ধান কেনা শুরু করতো তবে তাদের এ দুর্দশা হতো না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চাষি হাশেম আলী।
বেনাপোল কাস্টমস পরিসংখান সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ১৭ মে পর্যন্ত ১০ মাস ১৯ দিনে ভারত থেকে বিভিন্ন নামে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৪৫.২৯ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে উন্নত মানের চাল আমদানি দেখানো হয়েছে ৮৬ হাজার ৭৪৫.২৯ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরের (২০১৪-১৫) ১২ মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮৬.২৫ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে খাওয়ার উপযোগী উন্নতমানের চাল ছিল ৫ লাখ ১৫ হাজার ৯৮৬.২৫ মেট্রিক টন।
বর্তমানে ভারত থেকে আমদানিকৃত চালের ক্রয় মূল্যের ওপর সরকারকে ২০ শতাংশ শুল্ককর পরিশোধ করে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করছেন। এতে ভারতীয় সুপার মিনিকেট নামেরচালের আমদানি খরচ পড়ছে প্রতি কেজি ৪১ টাকা। দেশীয় বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়। আর দেশি মিনিকেট চাল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি কেজি ৩৪ টাকায়। ভারতীয় স্বর্ণা চালের আমদানি খরচ পড়ছে প্রতিকেজি ৩৪ টাকা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। আর দেশীয় স্বর্ণা চাল পাওয়া যাচ্ছে ২৬ টাকায়। গোবিন্দভোগ নামের চালের আমদানি খরচ পড়ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৮১ টাকায়।
আমদানিকারকরা জানান, ভারতীয় চালের মান উন্নত হওয়ায় দেশীয় বাজারে ওই চালের চাহিদা রয়েছে। তাই তারা আমদানি করছেন। তবে এখন নতুন ধান ওঠায় এবং ভারতীয় চালের ওপর সরকার আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় আমদানি কমেছে। তারা ব্যবসা ধরে রাখতেই কোনরকমে আমদানি করছেন।
চাল আমদানিকারকদের প্রতিনিধি বিপ্লব হোসেন জানান, সরকার যদি আমাদের দেশে চাষিদের মাঝে উন্নত জাতের ধানের বীজ সরবরাহ করতে পারে তবে ওই বীজ থেকে ভালো মানের চাল উৎপাদন করা সম্ভব। তখন ব্যবসায়ীরা ভারতীয় চাল আমদানি করবেন না। তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ওই উন্নত ধান চাষের জন্য কতটুকু উপযোগী তা কৃষিবিদদের গবেষণা করে দেখতে হবে। যদিও ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারত থেকে ওইসব জাতের ধানের বীজ এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাষ শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
এমজেএফ/