বরিশাল: বরিশালের পানের কদর বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে পান চাষিদের সংখ্যা। পান চাষের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পানকেন্দ্রিক শ্রম বাজারের ব্যবসার ধরনও বাড়ছে।
বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে চলা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের দু’পাশে বাটাজোর, ইচলাদি, মাহিলারাসহ ৫টি বাজারে শনি-রোব-মঙ্গল ও বুধবার বড় আকারে পানের হাট বসে। বছরের পর বছর ধরে চলছে একই নিয়মে।
এসব হাটে প্রতিদিন লাখ লাখ পানপাতা বিক্রির জন্য ওঠানো হয়। এসবের মধ্যে স্থানীয় বাবুগঞ্জ, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুরের চাষিদের পানই বেশি।
হাটগুলোতে গ্রামের চাষিরা পান নিয়ে আসার পর আকার ও মান দেখে এর দর ঠিক করেন পাইকাররা। এরপর ৭২টি পাতার সংযোজনে এক বিড়া করে পানের আঁটি কলাপাতার তৈরি অস্থায়ী সাজিতে সাজিয়ে কখনও ২শ আবার কখনও ৫শ বিড়া একসঙ্গে বাঁধা হয়। যেখানে পুরো পান গোনা-বাছা থেকে গাড়িতে ওঠানো পর্যন্ত এক মহাজনের হয়ে একজন শ্রমিক সাড়ে ৫শ টাকায় এক হাটে শ্রম দিয়ে থাকেন।
পরে তা পরিবহনে করে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সিলেট, ফেনী, মৌলভীবাজার, চৌমহনী, আখাউড়াসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় খুচরা বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম জানান, তিনি বাবার আমল থেকে পান চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ১শ শতাংশ জমিতে তিন শতক পানের বরজ রয়েছে তার।
তিনি জানান, এখন পানের বাজার ভালোই বলা চলে। বরিশালের পান মিষ্টি, পাতা বড় ও বোঁটা মাঝারি হওয়ায় এর কদরও বেশি। বর্তমানে আকার ও ভালো-খারাপ দেখে পানের বিড়াপ্রতি দর ২৫ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। তবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন পানের ভরা মৌসুম থাকে তখন বিড়াপ্রতি দাম পাঁচ থেকে সাত টাকায় ও নেমে আসে।
তিনি বলেন, তারপরও পান চাষের মজা হচ্ছে, একবার যদি পানের বরজ করা যায় আর কোনো রোগ-বালাই দেখা না দিলে তা দিয়ে যুগ পার করে দেওয়া যায়। অন্য ফসলের মতো বারবার নতুন করে জমি চাষ, আবাদের প্রয়োজন হয় না। অল্প পরিশ্রম ও জনবল দিয়ে পানের বরজ করা সম্ভব বিধায় তেমন একটা ক্ষতি হয় না চাষিদের।
অন্য এক ব্যবসায়ী মোস্তফা হাওলাদার জানান, শখের বসে এখনও পান চাষ আর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তার সঙ্গে শুরু করা অনেক চাষি লাভ না হওয়ায় উঠে গেছেন আবার অনেকে নতুন করে নামছেন। তবে এখন আর পানের দাম তেমন একটা পাওয়া যায় না। একে তো কাঁচামাল তার ওপরে এটি এখন জুয়ার মতো হয়ে গেছে। কখনও লাভ, কখনও লস- যে টিকে থাকবে এর মধ্যেই থাকবে।
তিনি বলেন, পান যদি এসব প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরাসরি রফতানি করা যেতো তবে চাষি সারাবছরই ভালো দাম পেতো।
চাষিদের মতে, পানের বরজে মূল খরচ হয় একবারই শুরুতে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পানের লতা কোপা হয়। একবার লতা বড় হয়ে গেলে সেখান থেকেই পরের বারের লতা পাওয়া যায়। ২০ শতাংশ জমিতে এক শতক বরজ (কান্দি) করা যায়। কান্দিগুলো মূলত ৩৫ থেকে ৩৬ ফুট লম্বা হয়। এ ধরনের একটি পূর্ণাঙ্গ বরজে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা খরচ হয়। বরিশালের আবহাওয়া পান চাষের জন্য অনুকূলে ও পানে রোগ-বালাই কম হওয়ায় স্বল্প পরিচর্যায় উৎপাদন ভালো হয়। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে সমস্যায় পড়তে হয় চাষিকে।
গৌরনদী-আগৈলঝাড়া অঞ্চলের চাষিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাসিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায় আবার দৈনিক হিসেবে ঘণ্টা বেঁধে তিন থেকে ৫শ টাকায় শ্রমিকদের ক্ষেতে কাজ করান। এক্ষেত্রে শ্রমিকরা একবেলা খাবারও পান। তবে চাষিদের মতে, নিজেরা খাটতে পারলে বেশি ভালো হয়।
এদিকে, সড়কের পাশের এসব পানের হাট ও চাষকে কেন্দ্র করে নানা ব্যবসা গড়ে উঠেছে। হাটগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, বাঁশের তৈরি এক ধরনের চিকন দড়ির ব্যবসা করছেন অনেকে। এই দড়ি পানের লতাকে খুটির সঙ্গে বাঁধতে কাজে লাগে। এটি দড়ির মতো কাজ করে এবং পানিতেও নষ্ট হয় না। এসব দড়ি মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ইশ্বরদী অঞ্চল থেকে কিনে এনে এখানে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হয় বলে জানালেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আ. খালেক সরদার।
কেউ বিক্রি করছেন পাট ও ছনের খড়ি। এগুলো ১৬০ পিস বিক্রি হচ্ছে চার থেকে ৫শ টাকায়। এগুলো দিয়ে বরজের বেড়া দেওয়ার কাজ করা হয়।
আবার কেউ বিক্রি করছেন বাঁশের কঞ্চি যা পানের লতাকে বড় হওয়ার কাজে সহায়তা করে। আকার ও সংখ্যাভেদে এগুলোও বিক্রি হয় আড়াইশো থেকে তিনশো টাকায়।
এছাড়া বরজের জন্য নাড়া (ধান গাছ) ও পানের আটি বাঁধার জন্য ব্যবহৃত কলাপাতা বিক্রি করা হয় এসব হাটে।
শ্রমিকের পাশাপাশি পান আনা-নেওয়ার কাজে টমটম-ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি চালিয়েও জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকে।
বরিশাল জেলায় এ বছর দুই হাজার ২শ ৫৩ হেক্টর জমিতে পানের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে গৌরনদী উপজেলায় সর্বোচ্চ ৮শ ৫০ হেক্টর জমিতে পানের বরজ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৬
এসএনএস