ঢাকা: একদিকে চ্যারিটি দেখিয়ে বিদেশ থেকে কনসালট্যান্ট আনা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই কনসালট্যান্টদের দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ব্র্যান্ড ফোরাম নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
বছরের পর বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানটি এমন কাজ করে যাচ্ছে, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন খোদ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি সেমিনার তারা আয়োজন করেছেন, যাতে অর্থ দিয়ে শিখতে আসছেন করপোরেট জগতের মানুষগুলো। তবে তাতে বিদেশ থেকে যারা বক্তৃতা করতে আসছেন তাদের অর্থ দেওয়া হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করপোরেট জগতে ক্যারিয়ার ক্রেজকে পুঁজি করেই ব্যবসা ফেঁদেছে ব্র্যান্ড ফোরাম নামের এ প্রতিষ্ঠানটি।
তারা এ ধরনের ব্যবসাকে ‘ব্যাড বিজনেস’ বলেই মত দিয়েছেন।
‘গাল ভরা বুলিতে মুঠোভরা টাকা তুলছে ব্র্যান্ড ফোরাম’ শিরোনামে মঙ্গলবার (০৪ অক্টোবর) সকালে বাংলানিউজে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শরিফুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রিপোর্টে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে যে হিসাব দেখানো হয়েছে, সেমিনার আয়োজন করে জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি নিয়ে ৬০ লাখ টাকা তুলছে ব্র্যান্ড ফোরাম, তা সঠিক নয়। ভেতরের খবর হচ্ছে, সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের অনেককেই ছাড় দেওয়া হয়। অনেকেই ১০ হাজার টাকায়ও রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ পান।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ হাজার বা ১৫ হাজার যে অংকই হোক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা অনেক বেশি ও অগ্রহণযোগ্য।
নিজের প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধনভুক্ত উল্লেখ করে কনসালট্যান্সিই এর মূল কাজ বলে জানান শরিফুল ইসলাম।
কনসালট্যান্ট হিসেবে কারা কাজ করছেন? সে প্রশ্নের উত্তর না দিলেও তিনি কারা ব্র্যান্ড ফোরামের ক্লায়েন্ট তার একটি বড় তালিকা দিয়েছেন।
বলেছেন, আমরা মার্কেটিং কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করি। সম্পূর্ণ ব্যবসাভিত্তিক এ সেবা অনেক প্রতিষ্ঠানই নিচ্ছে। আর কনসালট্যান্সি কাজের জন্য সরকার যে কর ধার্য করেছে সেই সমপরিমাণ কর আমরা পরিশোধ করে আসছি।
ব্র্যান্ড ফোরামের বাৎসরিক আয় কত ও তাতে কত টাকা কর দেন? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নকে ‘স্টুপিড কোশ্চেন’ বলেই মনে করেন ব্র্যান্ড ফোরামের এ শীর্ষ কর্তা।
এ ধরনের প্রশ্ন করা উচিত নয়, জানিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এটা জানাতে তিনি বাধ্য নন। কিংবা জানাবেন না।
৮ অক্টোবর ঢাকার পাঁচতারা হোটেললা মেরিডিয়ানে ব্র্যান্ড ফোরামের আয়োজনে কত খরচ হচ্ছে তাও জানাতে চাননি শরিফুল ইসলাম।
তবে এর আগে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এখানে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ আয় হচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। অন্যদিকে পুরো কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে দু’টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে স্পন্সর হিসেবে পেয়েছে ব্র্যান্ড ফোরাম। ধরে নেওয়া যায় সেখান থেকেও একটি বড় অংকের অর্থ আয় হবে আয়োজকদের।
বাংলানিউজের প্রশ্ন ছিলো, স্পন্সরড প্রোগ্রামে রেজিস্ট্রেশন ফি কেন? তার উত্তরে শরিফুল বলেন, ‘কারণ এটা ব্যবসা’।
যারা এ কর্মসূচিতে বক্তা হিসেবে আসছেন তাদের পাঁচতারা হোটেলে আবাসন ও বিজনেস ক্লাস এয়ার টিকেট দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে তারা কোনো অর্থ নেবেন না বলে জানান তিনি।
কেন তারা অর্থ নেবেন না? এই কনসালট্যান্টদের দেখিয়েই তো আপনি রেজিস্ট্রেশন ফি নিচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাবে শরিফুল বলেন, কারণ তারা জানে তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে অর্থ নেওয়া যায় না। এরা ধনী দেশ থেকে বড় অংকের চার্জ করে। তৃতীয় বিশ্বে ফ্রি সার্ভিস দেয়।
তারা কি তাহলে চ্যারিটি হিসেবে আসছেন? এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি শরিফুল।
তাহলে কনসালট্যান্টদের ফ্রি সার্ভিস দিয়ে ব্র্যান্ড ফোরাম কেন অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে। এটা কি একদিকে চ্যারিটি আরেকদিকে ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে না? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নেও শরিফুল বলেন, তিনি কোনো উত্তর দিতে চান না।
তিনি অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে মন্তব্য করেন, ‘বাংলানিউজ ব্র্যান্ড ফোরামের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করবে বলেই এমন প্রশ্ন করছে। ’
কনসালট্যান্টদের দেখিয়ে ক্রেজ তৈরি করা হচ্ছে, ক্যাম্পেইন চলছে, অর্থ আদায় করা হচ্ছে অথচ তাদের পেছনে সামান্য খরচ করে বাকিটা ব্র্যান্ড ফোরাম পকেটস্থ করবে, তাহলেতো কী সে কথাই ঠিক নয়, ‘গাল ভরা বুলিতে মুঠোভরা টাকা তুলছে ব্র্যান্ড ফোরাম’? বাংলানিউজের এমন প্রসঙ্গে ফোন লাইন কেটে দেন শরিফুল ইসলাম।
এ বিষয়ে বাংলানিউজের কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. বেলায়েত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ব্র্যান্ড ফোরাম যে উদ্যোগটি নিয়েছে তা যদি উপকারেও লাগে তাও তাদের পন্থাটি অবৈধ।
বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে নিজেদের ব্যবসা করার এ প্রক্রিয়া দেশের ক্ষতি ডেকে আনবে, এমন মত দিয়ে অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন বলেন, এক পর্যায়ে এই কনসালট্যান্টরা বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করবেন।
আয়োজনটি স্পন্সরড, বিদেশি কনসালট্যান্টদেরও অর্থ দিতে হচ্ছে না, এ অবস্থায় ব্র্যান্ড ফোরামের এতো মোটা অংকের রেজিস্ট্রেশন ফি আদায় একটি ‘ব্যাড বিজনেজ’, বলেন এই ঢাবি অধ্যাপক।
তিনি বলেন, সৎ উদ্দেশ্য থাকলে দেশের সম্ভাবনাময় তরুণদের নির্বাচন করে তাদের বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে এমন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারতো প্রতিষ্ঠানটি।
ব্র্যান্ড ফোরামের এ কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে অর্থায়ন করছে হুয়াই ও এসএসডিটেক নামের দু’টি প্রতিষ্ঠান।
এতে আলোচনা করতে আসবেন ফেসবুক ক্রিয়েটিভ শপ ফর অ্যাপাক এর পরিচালক ফার্গুস ও’হ্যারে, আলিবাবা গ্রুপের প্রোডাক্ট অপারেশন ম্যানেজার মেহেদি রেজা, গ্রে গ্রুপ এশিয়া প্যাসিফিক এর ডিজিটাল লিড সুরেশ রামাস্বামী ও আইএমআরবির মিডিয়া বিজনেস’র ভাইস প্রেসিডেন্ট হেমন্ত মেহতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৬
এমএমকে/এএ