ঢাকা: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের দোহাই দিয়ে বিদেশি কাগজ কিনতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। আন্তর্জাতিক মানের কাগজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশীয় শিল্পকে উপেক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এমন পদক্ষেপে অনেকে রহস্যজনক মনে করছেন।
সূত্র জানায়, বিদেশি কাগজের শর্তারোপ করে দু’টি টেন্ডারও (দরপত্র) আহ্বান করেছে স্টেশনারি অফিস। প্রতিষ্ঠানটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশে বিদেশি কাগজ কেনা হচ্ছে।
তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য উন্নতমানের ‘এ-ফোর’ সাইজের সাদা অফসেট বিদেশি কাগজ কিনতে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক মো. হামিদুল হক গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- এক লাখ ৫০ হাজার রিম বিদেশি ‘ডাবল-এ’ বা সমমনা ব্র্যান্ডের কাগজ রাজস্ব খাতের অর্থায়নে কেনা হবে। পরের দিন গত ২৬ সেপ্টেম্বর আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আরও ২০ হাজার রিম বিদেশি ‘ডাবল-এ’ বা সমমনা ব্র্যান্ডের কাগজ কেনা হবে।
জানা যায়, দেশে যে পরিমাণ কাগজের চাহিদা রয়েছে, তার দ্বিগুণ বেশি উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে দেশীয় কাগজ মিলগুলোর। উৎপাদিত কাগজ বিশ্বমানের হওয়ায় রপ্তানিও হচ্ছে। তবুও আমদানি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিদেশি কাগজ।
দেশীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ কাগজই নিম্নমানের। অথচ দেশে উৎপাদিত উন্নত মানের কাগজ কিনছে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, টাকশাল, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে সরকারের স্টেশনারি অফিস বিদেশি কাগজ কেনার উদ্যোগে স্থানীয় বিকাশমান কাগজশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের উপ-পরিচালক মো. হামিদুল হক বলেন, আসলে মন্ত্রণালয়ের ব্র্যান্ডিং চাহিদা থাকে কিছু। তারা ‘ডাবল এ বা পেপার ওয়ান’ নামের কাগজ চায়। আমরা নিজের চাহিদায় কোনো কাগজ কিনি না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলে দেয়- ডাবল এ বা পেপার ওয়ান কাগজ লাগবে। আমিও জানি দেশে অনেক ভালো কাগজ তৈরি হয়। আমরা এর আগেও কিনেছি। দেশে অনেক ভালো ভালো ব্র্যান্ডের কাগজ আছে। কিন্তু আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আমরা তো অন্যের চাহিদার ভিত্তিতে কিনি, এটাই হচ্ছে সমস্যা।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) সচিব এ কে এম নওশেরুল আলম জানান, দেশের কাগজশিল্প এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে শতাধিক কারখানা আছে। এই কারখানাগুলো বছরে ১৪ লাখ টন কাগজ উৎপাদনে সক্ষম। দেশে উৎপাদিত সব ধরনের কাগজই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এমনকি দেশীয় পুরো চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের সদস্য কারখানাগুলো বিশ্বের ২৫ থেকে ৩০টি দেশে বিভিন্ন জাতীয় কাগজ ও কাগজজাত পণ্য রপ্তানি করছে।
তিনি বলেন, যেখানে সরকার দেশীয় শিল্প সুরক্ষার চিন্তা করছে সেখানে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস কী উদ্দেশ্যে বিদেশি কাগজ আমদানি উৎসাহিত করতে টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করেছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
নওশেরুল আলম বলেন, আমাদের মনে হয়, এমন কর্মকাণ্ড কিছুটা উদ্দেশ্যমূলক। কারণ, আমরা যে মেশিন ও উপকরণ বা কাঁচামাল দিয়ে কাগজ উৎপাদন করি, বিদেশিরাও তা-ই করে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে উৎপাদিত কাগজ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি কাগজের চেয়েও উন্নত মানের কাগজ আমরা উৎপাদন করি।
তিনি বলেন, ‘সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন— সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার, বিভিন্ন দূতাবাস আমাদের দেশীয় কাগজ কিনছে। সেখানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি কাগজ প্রোমোট (উৎসাহিত) করছে, এটা আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়।
‘সরকার যেখানে শিল্পায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত করতে কাজ করছে, সেখানে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার একটি প্রচেষ্টা রহস্যজনক। তারপরও আমরা আশা করব, ওই প্রতিষ্ঠানটি কোনো সুনির্দিষ্ট বিদেশি কাগজ উল্লেখ না করে, দেশি-বিদেশি সবাইকে সমান সুযোগ দেবে’- যোগ করেন নওশেরুল আলম।
জানা গেছে, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, ব্যাংকের চড়া সুদ, অবকাঠামো সমস্যাসহ বিভিন্ন অসুবিধার কারণে এমনিতেই দেশে কাগজ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ছে। দেশের চালু কাগজকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন। অন্যদিকে দেশে সব ধরনের কাগজের মোট চাহিদা ৬ থেকে ৮ লাখ টন। সে হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টন কাগজ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে।
দেশের কাগজশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১৪ লাখ মানুষের জীবিকা। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, বিদেশি কাগজে দেশ সয়লাব হয়ে গেলে এ খাতে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বিপন্ন হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৬
টিআই