ঢাকা: বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেই বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দিতে দ্বিধাবোধ করছে না বলে জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
ইআরডি জানায়, গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক ঋণের ডেট স্টক ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এসব ঋণ দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। কোনো কোনো ঋণের বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে থেকেই।
এসব ঋণ জমা হতে হতে এ পর্যায়ে ঠেকেছে, যাকে ঋণের ডেট স্টক বলে ইআরডি।
ইআরডি সূত্র জানায়, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ক্রেডিট রেটিংও ভালো।
আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স, মুডি’স এবং ফিচ রেটিংসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো।
যাকে ‘স্ট্যাবল ইকোনমি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থাগুলো। কোনো দেশকে ঋণ দেওয়া কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ- তারই মূল্যায়ন ক্রেডিট রেটিং।
অর্থাৎ রেটিং যতো ভালো, ঋণ দেওয়া ততো কম ঝুঁকির। আর তা কমা মানে ঋণের অর্থ ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি বাড়া। তাই রেটিং কমলে সাধারণত বেশি সুদ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা নেই বলেও জানায় ইআরডি।
ইআরডি জানায়, বছরে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলার থেকে এক দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করছে। এক একটি সংস্থার সুদের হার আলাদা।
যেমন- সুদের হার কমিয়ে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) মার্কিন ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
২০১৬ থেকে ২০২০ সাল মেয়াদে সহজ শর্তে বাংলাদেশকে এ অর্থ ঋণ আকারে দেবে আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থাটি। যা গত ৫ বছরে এডিবি থেকে প্রাপ্ত সহায়তার চেয়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি।
প্রদত্ত ঋণের ৫০ শতাংশ হবে কনসেশনাল আর বাকি ৫০ শতাংশ হবে বাজারভিত্তিক। বাজারভিত্তিক ঋণে সুদ হবে লাইবর প্লাস পয়েন্ট ৫০ শতাংশ। আর কনসেশনাল ঋণে সুদের হার হবে ২ শতাংশ। এডিবির সহজ শর্তের ঋণ (ওসিআর) ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৫ বছরে পরিশোধ করতে হবে।
ইআরডি জানায়, সামনে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। চীন আগামীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ২৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে। বর্তমানে ঋণের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে রাশিয়া।
দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের মূল প্ল্যান্ট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ১১ দশমিক ৩৮০ বিলিয়ন ডলার দিবে রাশিয়া। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের প্রতিশ্রুত ঋণচুক্তি হলে আরেক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হবে বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে।
ইআরডি জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট চুক্তির সংখ্যা ৯৭টি। উন্নয়ন সহযোগীরা প্রতিশ্রুত সাড়ে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ছাড় করেছে তিন বিলিয়ন ডলার। এ অর্থবছরে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধ করেছে এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) মার্কিন ডলারেরও বেশি। এর মধ্যে আসল ৯০ কোটি ডলার এবং সুদ ১০ কোটি ডলার।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট চুক্তির সংখ্যা ৮২টি। উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি ছিল ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ছাড় করেছে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। এ অর্থবছরে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধ করেছে ১০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে আসল ৯০ কোটি ডলার এবং সুদ ১০ কোটি ডলার।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে অনুদানের পরিমাণ বেশি ছিল। উন্নয়ন সহযোগীরা অনুদান দিতো ৯০ শতাংশ আর ঋণ দিতো মাত্র ১০ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না- এ ভয়ে উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দিতো না। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে এ চিত্র পুরো পাল্টে গেছে। এখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া হচ্ছে না বললেই চলে। এখন বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৯৫ শতাংশ আর অনুদান মাত্র ৫ শতাংশ।
ইআরডি’র অতিরিক্ত সচিব (বৈদেশিক সাহায্য বাজেট ও হিসাব শাখা) ফরিদা নাসরীন বাংলানিউজকে বলেন, ‘যেসব সংস্থা ক্রেডিট রেটিং করে, তারা ভালো ফলাফল দিয়েছে। এ তিন রেটিংয়ে আমাদের অবস্থা স্ট্যাবল ইকোনমি। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ভালো বলেই উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে’।
‘চলতি অর্থবছরে আমাদের টার্গেট ছিল ৬ বিলিয়ন ডলার, এটি ছাড়িয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হবে। চীন ও রাশিয়ার ঋণ যোগ হলে তা ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমরা এখন আর অনুদান গ্রহণকারী দেশ নই। আমরা ঋণ পরিশোধে সক্ষম, এটি আমাদের সক্ষমতা। আমরা ঋণ নিতে পারি। কারণ, পরিশোধের সক্ষমতা আমাদের আছে। আমরা আর গরিব দেশ না’।
বাংলাদেশ সময়: ০০২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর