ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

জামায়াতের রাহুমুক্ত ইসলামী ব্যাংক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৭
জামায়াতের রাহুমুক্ত ইসলামী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের লোগো

ঢাকা: দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জামায়াতের রাহুমুক্ত হচ্ছে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক। সরকারের উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদে অর্থায়নের মতো বহুল আলোচিত নেতিবাচক ইস্যু থেকে ইতিবাচকতার দিকে হাঁটছে প্রতিষ্ঠানটি। আর্থিক খাতে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদরাও সরকারের এ উদ্যোগে দিচ্ছেন ইতিবাচক সাড়া।

বিশেষজ্ঞ মত, সরকারের এ ধরনের সাহসী উদ্যোগের কারণেই একচেটিয়াভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। এতে ঝুঁকিমুক্ত হচ্ছে দেশের অন্যতম একটি আর্থিক খাত।

স্বাধীনতার প্রায় ৪৫ বছর পর দেশের ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের পরিবর্তনের ঘটনা এটিই প্রথম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে দেশের কোনো ব্যাংক থাকবে এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, সুস্থও নয়। সরকার যেভাবে চাইছে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে, সেটি দেশের স্বার্থেই। এই ইসলামী ব্যাংকে কর্মরতদের ৯৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাকগ্রাউন্ড জামায়াত-শিবিরের। গতবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার উপরে লাভ করেছে এ ব্যাংকটি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী যে ভয়াবহ সহিংসতা, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারাসহ রাস্তা-ঘাট অবরোধ করে যে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছিল তার জন্য জামায়াত-শিবিরকেই দায়ী করা হয়। দেশবিরোধী সেসব কর্মকাণ্ডে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে তার যোগানদাতা বা উৎস কী- তা নিয়েও দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে।

কারও কারও মনে সন্দেহ, এই ব্যাংকের লাভের টাকায় দেশের জনগণের সম্পদ নষ্টের তৎপরতা চালিয়েছে এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে জামায়াত। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও ডালপালা গজাতে থাকে জামায়াতের কার্যক্রমের। তাদের প্রধান অর্থ যোগানদাতা প্রতিষ্ঠান এই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় এরশাদেরই আমলে, ১৯৮৩ সালে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাযর্কর হওয়া জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাংকটি, সেসময় তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে দায়িত্ব নেন। এর পর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পদেও দায়িত্ব নেন। এই মীর কাসেম ছিলেন জামায়াতেরই আরেক প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা ট্রাস্ট (প্রশাসন) ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের বোর্ড অব ডিরেক্টরের।

২০১৩ সালে দুই বছরের জন্য ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আবু নাসের মো. আবদুস জাহের। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য। বর্তমান সরকার যখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেয় তখন তিনি দেশত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন মুস্তফা আনোয়ার। তিনিও জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ইবনে সিননা ট্রাস্টের প্রতিনিধি। মুস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে গত বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) বোর্ডসভায় নতুন চেয়ারম্যান করা হয় কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খানকে। একইসঙ্গে এই বোর্ডে নির্বাহী কমিটির প্রধান করা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অাব্দুল মতিনকে।

গত ৩৩ বছর ধরে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এ ব্যাংকটি একচেটিয়াভাবেই ব্যাংকিং খাতে ব্যবসা করে আসছিল। একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকটি দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে ধরনের নেতিবাচক ভূমিকা রাখছিল তা নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলে রয়েছে তুমুল সমালোচনা। একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিপুল অংকের লাভের টাকা দেশবিরোধী ভূমিকায়, বিশেষ করে জঙ্গি অর্থায়নে ব্যবহৃত হচ্ছিল কি-না ‍তা নিয়েও অনেক তদন্ত চলছে।

এরকম পটভূমিতে সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতমুক্ত করার জন্য ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে সরকারের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন লোকজনদের ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের দেশবিরোধী নেতিবাচক কর্মকাণ্ড এ ব্যাংকটির মাধ্যমে পরিচালিত না হয়।

ইসলামী ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ ইসলামী ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ করা এ ওয়েবসাইটে ব্যাংকটির ৩১৮টি শাখার কথা উল্লেখ রয়েছে। ৩৩ হাজার ৬৪৬ জন শেয়ারহোল্ডার রয়েছে ব্যাংকটির। যার মধ্যে ৬৩ শতাংশই বিদেশি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, সরকারের পলিসির অংশ হিসেবেই ইসলামী ব্যাংকের এ পরিবর্তন। জেনে-বুঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে‌ই সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের জন্য ব্যাংকটিতে এ ধরনের পরিবর্তন আনলো।

দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক আদর্শ বিস্তারের যে কৌশল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে করা হতো, সেটি তার বিদেশি মালিক বা পরিচালকরাও জানতেন না। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এসব মালিকরা জামায়াতের এ ধরনের মনোভাব জানার পর নিজ থেকেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যায়।

ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রসঙ্গে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচারক আবুল মকসুদ বলেন, আপাতত একটি ভালো কাজ হয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে ব্যাংকটির স্বার্থ রক্ষা করে পরিচালনা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এটি একটি বড় সিদ্ধান্ত। এর ভালো-মন্দের প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। প্রায় ছোটখাট ৩-৪টি ব্যাংকের সমান হবে ইসলামী ব্যাংকের আকার।

দেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে ব্যাংকের মালিকানা দেওয়া হলেও পুরো ব্যাংকের একক নিয়ন্ত্রণ নেই আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলেরও, যারা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বা আছে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেন, ইসলামের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে রাজনীতির কাজে লাগিয়েছে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংকের পরিচালকরা। সরকার নিয়ম-নীতি মেনে আইনসিদ্ধভাবেই এর মালিকানায় পরিবর্তন এনেছে দেশের স্বার্থে। আমি মনে করি এটি সঠিক কাজ এবং আমাদের প্রত্যাশাও ছিল এরকম। কারণ ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তারা সবাই জামায়াত কানেকশনের। জঙ্গি অর্থায়নের কথাও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৭
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।