ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ভৈরবের সম্ভাবনাময় পাদুকাশিল্পে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৯
ভৈরবের সম্ভাবনাময় পাদুকাশিল্পে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা ভৈরবের একটি দোকানে বাহারি জুতো। ছবি: বাংলানিউজ

ভৈরব থেকে ফিরে: দেশে অপার বাণিজ্যিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের ১২ হাজার পাদুকাশিল্প কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি জুতা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বছরে হাজার কোটি টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। অথচ ব্র্যান্ডিং, বাজারজাতকরণ, দক্ষ কারিগর, পুঁজির স্বল্পতা ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না এ শিল্প।

প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলেও মিলছে না সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। তাই এ শিল্পের জন্য আলাদা একটি শিল্পনগরী ঘোষণা, আধুনিক কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার, স্বল্পসুদে ঋণ ও উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, পণ্যের ব্র্যান্ডিং, বাজারজাত করতে বিভিন্ন মেলায় ও বিদেশি বায়ার বা ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরিসহ পাদুকা আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী এবং কারখানা মালিকরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, ভৈরবের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে হাজার হাজার পাদুকা শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন। অথচ সম্ভাবনাময় এ শিল্পে নেই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ এবং সার্বিক সহায়তা পেলে এই শিল্পের দ্রুত বিস্তার ঘটবে। ব্যাংক ঋণসহ অন্যান্য জটিলতা দূর করা গেলে পাদুকাশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যা একদিন জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখ করার মত অবস্থান অর্জন করবে। পাদুকা কারখানায় চলছে কর্মযজ্ঞ।  ছবি: বাংলানিউজভৈরব পাদুকা মালিক সমিতির সভাপতি আল আমিন মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, খুব অল্প পুঁজি হলেই পাদুকা ব্যবসা শুরু করা যায়। তাই পাদুকা কারখানা শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রায় ১২ হাজার কারখানায় ৬০ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বেশিরভাগ কারখানাই ছোট। এখানকার কারখানা মালিকরা পুঁজির অভাবে অনেকেই অটোমেশিন কিনতে পারেন না। এজন্য এসএমই ফাউন্ডেশন ইস্টার্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সহজ শর্তে একটি ফান্ড দিলেও নানা কারণে ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ লাখ টাকার জামানত দিতে হয়। এ ধরনের শর্তের কারণে সেখান থেকে ঋণ নিতে পারছে না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক কিছু ক্ষুদ্র লোন দিলেও বড় লোন তারা দেয় না। ইসলামী ব্যাংক গ্রুপ লোন বেশি দিচ্ছে। সেজন্য সরকার সুদমুক্ত বা স্বল্পসুদে নির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ব্যবসা বাড়ানোসহ কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। পাদুকা কারখানায় চলছে কর্মযজ্ঞ।  ছবি: বাংলানিউজআল আমিন আরও বলেন, বর্তমানে চাইনিজ, বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান পাদুকায় মার্কেটগুলো ছেয়ে গেছে। বিদেশি পাদুকা দেশীয় পাদুকা বাজারের জন্য হুমকি। এজন্য বিদেশ থেকে পাদুকা পণ্য আমদানি নির্ভরতা কমানোসহ এই শিল্পে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য কর্মীদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একইসঙ্গে ব্যবসায়ীদের জন্য একটি ‘কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার’ তৈরিসহ বিসিক শিল্পনগরীর মতো একটি পাদুকা শিল্পনগরী গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

এ বিষয়ে ভৈরব পাদুকা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সবুজ মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ভৈরবের কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হয়। চাহিদা থাকলে উৎপাদন তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব। এখানকার জুতার মান ভালো হওয়ায় অ্যাপেক্স, বাটা, লোটো, জিনিয়াস, জিলস এর মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে পণ্য নেয়। সরকার যদি এ শিল্পে সুনজর দেয়, তাহলে পোশাক খাতের মতো এ শিল্পও দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। এজন্য সরকারকে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ, বিদেশি পাদুকা আমদানি বন্ধসহ একটি পাদুকা শিল্পনগরী গড়ে তুলতে হবে। নইলে ভৈরবের পাদুকা শিল্প একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। পাদুকা কারখানায় চলছে কর্মযজ্ঞ।  ছবি: বাংলানিউজভৈরবের পাদুকা ক্লাস্টার ঘুরে দেখা যায়, আপার, কাটিং, পেস্টিং, সোল, ফিটিং, ফিনিশিং, স্ক্রিন প্রিন্ট, কালারসহ ৮টি ধাপে কারিগরদের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে এক একটি জুতা। এ কাজে কারিগররা ডজন হিসেবে মজুরি পেয়ে থাকেন। প্রকারভেদে প্রতি ডজনে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা হিসেবে মজুরি পান কারিগররা। একজন কারিগর দৈনিক ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা আয় করতে পারেন।

এদিকে, পাদুকা তৈরির উপকরণের ৫০০ থেকে ৬০০ দোকান গড়ে উঠেছে ভৈরবে। এছাড়া রয়েছে বক্স তৈরির অন্তত শতাধিক কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানেও কাজ করছেন প্রায় ১৫-২০ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন এখান থেকে হাজার হাজার কার্টন পাদুকা রেল, সড়ক ও নৌপথে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, বরিশাল এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভৈরবে তৈরি পাদুকা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে। হিসাব কষলে এখানে প্রতিদিন কোটি টাকার পাদুকা বিক্রি হয়ে থাকে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের সুষ্ঠু বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই শিল্পায়ন, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে এসডিজি গোল বাস্তবায়নের নিমিত্তে এসএমই ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ক্লাস্টারভিত্তিক সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে ভৈরবের ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণের জন্য কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছে। কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ফাউন্ডেশন। এছাড়া গত ৮ বছরে ধরে এ খাতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন, পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করছে ফাউন্ডেশন, পাশাপাশি সারাদেশের এসএমই মেলার আয়োজনে এই শিল্পের অংশগ্রহণ থাকে।

নব্বইয়ের দশক থেকে পাদুকা তৈরির অঞ্চল হিসেবে খ্যাতি লাভ করে কিশোরগঞ্জের ভৈরব। গ্রাম-শহর মিলে পাদুকা শিল্পকে ঘিরে ভৈরবে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার ছোট-বড় কারখানা। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের। ৫ হাজারের মত নারী কর্মীও পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ১৯৮৬ সালে পাদুকা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্যাপক প্রসার ঘটে এ শিল্পের।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৯
জিসিজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।