ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারতের বাজার আগাম পর্যবেক্ষণ জরুরি

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৯
মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারতের বাজার আগাম পর্যবেক্ষণ জরুরি পেঁয়াজ। ফাইল ছবি

ঢাকা: সরকারের নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও কমছে না পেঁয়াজের দাম।  ক্রেতার  নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে অত্যাবশ্যক পণ্যটি। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে দেশের পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ করা হয়। 

গত ১৩ সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ন্যূনতম মূল্য প্রতি মেট্রিক টনে ৮৫০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে।

চলতি বছরে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম বাড়ে। দাম যাতে আর না বাড়ে, সে জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাজারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।  
 
এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পক্ষ থেকে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন দেশের পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি ও প্রতিযোগিতার অবস্থা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

এছাড়া কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও খাদ্য অধিদপ্তর এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন গবেষকেরা। বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদের নেতৃত্বে ‘অনিয়ন মার্কেট অব বাংলাদেশ: রোল অব ডিফরেন্ট প্লেয়ার্স অ্যান্ড অ্যাসেজিং কম্পিটিভন্স’ নামক মূল গবেষণাটি করা হয়।
 
বিআইডিএস’র গবেষণায় বলা হয়, পেঁয়াজ ৬০ শতাংশ দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে, বাকি ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ভারত থেকেই মূলত পেঁয়াজ আমদানি করে। ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিকে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এছাড়া দক্ষিণ ভারত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট অঞ্চলে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এ বছর ভারতের সব অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার ফলে উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ভারতের স্থানীয় বাজারে অস্বাভাবিক হারে পেঁয়াজের দাম বাড়ে। এ কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ বিষয়টি সরকার ভালোভাবে মনিটরিং করেনি। যেহেতু বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার ভারত নির্ভর। এ বিষয়টি আগাম মনিটরিং করে বিকল্প বাজার খুঁজলে বর্তমান পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতো। বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারতের বাজার সব সময় পর্যবেক্ষণ জরুরি। ভারতে বন্যার সময় থেকেই বাংলাদেশের আরও সতর্ক হয়ে বিকল্প বাজার খোঁজা জরুরি ছিল বলে মনে করে বিআইডিএস।

গবেষণায় আরও বলা হয়, পেঁয়াজ অত্যাবশ্যক পণ্য। ধনী-গরিব সবার কম বেশি পেঁয়াজ লাগে। ভারতের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের খবরে ব্যক্তিগতভাবে সবাই পেঁয়াজ মজুদ বাড়িয়ে দিয়েছে বাড়তি দাম পাওয়ার আশায়। আমদানি নির্ভর কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। ধানের মতো পেঁয়াজের হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এছাড়া যখন পেঁয়াজের দাম কম থাকে তখন সরকারের উচিত পেঁয়াজ কিনে মজুদ করা। যাতে আপদকালীন সময়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা যায়। প্রতিটি পরিবারে মাসে চার থেকে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগে। সুতরাং, ৫০ টাকার পরিবর্তে ২৫০ টাকায় পেঁয়াজ কিনলে বাড়তি এক হাজার টাকা গরিব মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। তাই দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোসহ ভারতীয় বাজার মনিটরিংয়ে জোর দেওয়ার কথা বলা হয় বিআইডিএস’র গবেষণায়।

আমদানির ৯৫ শতাংশের ওপরে ভারতীয় পেঁয়াজ: দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। দেশে উৎপাদন হয় ১৬ থেকে ১৭ মেট্রিক টন। বাকি ৮ থেকে ৯ মেট্রিক টন আমদানি করা হয়। যার ৯৫ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট আমদানির ৯৫ শতাংশ পেঁয়াজ ভারত থেকে এসেছে। এরপরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০০ শতাংশ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ পেঁয়াজ ভারত থেকে এসেছে। এর পাশাপাশি চীন, মিশর, পাকিস্তান ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। সুতরাং বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজার ঠিক রাখতে ভারতের বাজার মনিটরিং জরুরি বলেও বিআইডিএস’র গবেষণায় উঠে এসেছে।
 
উৎপাদন বাড়লেও ঘাটতি বাড়ছে: দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা বাড়ায় ঘাটতি বাড়ছে। ফলে উৎপাদন ও ঘাটতি সমানতালে বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১১ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, এ সময়ে মাত্র ৩ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এ অর্থবছরে মোট পেঁয়াজের চাহিদা হয় ১৫ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১৭ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। পাঁচ বছর পর উৎপাদন বাড়লেও ৬ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে চাহিদা মেটাতে গবেষণায় হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ উৎপাদনের কথা তুলে ধরেছে বিআইডিএস।

বিশ্বে পেঁয়াজ রপ্তানিতে শীর্ষে ভারত: বিশ্বে চীন পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হলেও রপ্তানিতে শীর্ষে ভারত। বর্তমানে ভারতে ১৯৪ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সারা পৃথিবীতে বছরে পেঁয়াজের মোট চাহিদা ৯৩২ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। সুতরাং ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদনে ঘাটতি হলেও বাংলাদেশসহ বিশ্বে এ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ভারতের বন্যার বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা এড়িয়ে গেছে। ফলে ভোক্তাদের মাশুল গুণতে হচ্ছে। পেঁয়াজ উৎপাদনের শীর্ষে চীন, সারা পৃথিবীর ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ পেঁয়াজ এ দেশে উৎপাদন হয়। এর পরিমাণ ২৩৯ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন। তবে বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে পেঁয়াজের চাহিদাও বেশি। এরপরেই রয়েছে মিশর, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ফলে বিশ্বে পেঁয়াজের বাজার মূলত ভারতই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
 
ভারতের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের ঘোষণায় সবাই বনে গেলো মজুদদার: বিআইডিএস গবেষণা বলছে, চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ। ভারতের এ ঘোষণা পাওয়া মাত্রই পেঁয়াজ মজুদ শুরু হয়। সবাই জানে পেঁয়াজ সবার প্রয়োজন, পাশাপাশি জানে ভারত পেঁয়াজ না দিলে দাম বাড়বেই। এসব কারণে যে যেভাবে পেড়েছে পেঁয়াজ মজুদ করেছে। এ কারণেই মূলত বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। রাজধানীর শ্যামবাজার ঢাকা শহরের মধ্যে সব থেকে বড় পেঁয়াজের বাজার। এ বাজারে মূলত ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও মাগুরা থেকে পেঁয়াজ আসে। আড়তদার, কমিশন  এজেন্ট, হোলসেলার, ফরিয়া থেকে শুরু করে যার কাছেই পেঁয়াজ ছিল দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পেঁয়াজ দাম বাড়তে বাড়তে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
 
গবেষণা প্রসঙ্গে বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে এমন গবেষণা প্রথম। গবেষণায় উঠে এসেছে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে তিনটা জিনিস গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন বাড়ানো, যোগান ও ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রণ। হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন করে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। সরকারের উচিত পেঁয়াজের মৌসুমে পেঁয়াজ কিনে মজুদ করা। যখন পেঁয়াজ থাকবে না তখন কম দামে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হবে। ’
 
তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে আমরা ভারত নির্ভর। তাই ভারতের বাজার আমাদের আগে মনিটরিং করতে হবে। কারণ ভারত না খেয়ে আমাদের পেঁয়াজ দেবে না।  তাই ভারতের সংকট হলে দ্রুত সময়ে আমাদের বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। ’
 
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, পেঁয়াজ আমাদের অত্যাবশ্যক পণ্য। পেঁয়াজের সংকট দেখতে চাই না। বিআইডিএসকে দিয়ে পেঁয়াজের গবেষণা করেছি। পেঁয়াজ নিয়ে স্থায়ী সমাধান খুঁজতেই এমন উদ্যোগ। পেঁয়াজ নিয়ে একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি আর হতে চাই না। তাই এনিয়ে যা করণীয় তাই করবে প্রতিযোগিতা কমিশন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৯
এমআইএস/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।