এছাড়া ভারত, ইকুয়েডর ও ভিয়েতনামে ভেনামি জাতের চিংড়ির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ভেনামি চাষে উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়।
দেশের বাজারে উৎপাদন কমা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারাসহ নানা কারণে সংকটে দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য চিংড়ি। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রান্তিক চিংড়ি চাষি থেকে শুরু করে চিংড়ির সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় সরকারি সহযোগিতা না পেলে সর্বশান্ত হয়ে পড়বেন এ খাতের সঙ্গে জড়িতরা। হারিয়ে যাবে চিংড়ি শিল্প।
করোনার প্রভাবে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২০ লাখ চাষি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় দেশের সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয়। ঘের মালিকরা তাদের চাষকৃত চিংড়ি আড়ৎগুলোতে সরবরাহ করেন। আর হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় মৎস্য আড়তদারদের কাছ থেকে বাগদা অথবা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সেটি বিদেশে রপ্তানি করে থাকে।
করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আড়ৎগুলো থেকে চিংড়ি সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। এরফলে পাইকারি বাজারে মাছের দরপতন হয়। সেই প্রভাব গিয়ে পড়ে ঘের ব্যবসায়ীদের ওপর।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, হিমায়িত চিংড়ি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। দেশের সবচেয়ে বেশি চিংড়ি চাষ হয় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর জেলাতে। দেশের রপ্তানি বাজারে অন্যতম সম্ভাবনাময় এ খাত চলমান করোনায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। করোনার কারণে সব সেক্টরের সাথে চিংড়ি সেক্টরও হুমকির মুখে পড়েছে। করোনার কারণে চিংড়ি শিল্পে ধস নেমে এসেছে। অনেক দেশ চুক্তি বাতিল করেছে।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, চিংড়ির প্রধান ক্রেতা আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর এসব আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বহু ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে।
তারা জানান, করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দাম কমেছে। বিভিন্ন মাছ কোম্পানির প্রায় ৩০০টির মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল হয়েছে। ফলে ওই মাছগুলো হ্যান্ডওভার করা সম্ভব হয়নি।
বিগত বছর গুলোতে এ অঞ্চলের সাদাসোনা খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ি জাপান, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, চীন, ইতালি, মরিশাস, ইউএই, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, সাইপ্রাস ও ডেমোনিকান রিপাবলিকে রপ্তানিতে সাফল্য এলেও করোনার কারণে শিপমেন্ট না হওয়ায় চিংড়ির বাজার হাতছাড়া হতে যাচ্ছে।
এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, করোনায় তাদের সীমাহীন ক্ষতি হচ্ছে। এ শিল্পের অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, খুলনায় চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৯টি । এর মধ্যে ২৩টি বর্তমানে চালু রয়েছে। করোনার কারণে চালুকৃত এসব প্রতিষ্ঠান চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আছিয়া সী ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম জহির বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে চিংড়ি শিল্পেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শুধু ব্যবসা করা গেছে। এর পর থেকে করোনা ভাইরাসের কারণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়া শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে ১৫টি চুক্তি ছিলো। তার মধ্যে ১০টি বাতিল হয়ে গেছে। যে কারণে প্রায় ১৪ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল হয়। আমাদের মতো ১০০ ভাগ ক্যাপাসিটির কোম্পানিগুলো ৩০ ভাগ ব্যবহার করছি। মাছ কম অর্ডারও নেই। প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে চিংড়ি শিল্পের সাথে প্রায় ২০ লাখ লোক জড়িত রয়েছেন।
সরকারি প্রণোদন পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাময়িক সহযোগিতা পেয়েছি। শ্রমিকদের এপ্রিল মাসের বেতন হিসেবে ২ শতাংশ সুদ দিতে হবে সেই শর্তে সাময়িক লোন পেয়েছি। আমাদের কোম্পানির মালিকদের জামানত ও লোন ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি দিতে হয়েছে। এটার ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জ আমাদের দিতে হবে। কিন্তু মে মাসের বেতন ও ঈদের বোনাস আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে হয়েছে।
তারিকুল ইসলাম জহির জানান, চিংড়ির ঘেরে উৎপাদন কম, অন্যদিকে বিশ্ব বাজারে অর্ডার নেই। বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের মাছগুলো হোটেল রেস্টুরেন্টে চাহিদা ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে হোটেল রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় মাছে তেমন চাহিদা নেই। কিছু সুপারশপ চালু থাকায় সেখানে কিছু চিংড়ি চলে।
ক্রীমসন রোজেলা সীফুডস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. শাহীন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সকল সেক্টরের মতো চিংড়ি সেক্টরেও একটা চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ১০-১২টা ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে আমাদের চিংড়ির চাহিদা কমে আসছে। বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারত, ইকুয়েডর ও ভিয়েতনামে ভেনামি জাতের চিংড়ির ব্যাপক চাষ হচ্ছে। ভেনামি চাষে উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হয়। ফলে কম মূল্যে সরবরাহ করার কারণে বাজার দখলে ভেনামির সঙ্গে পেরে উঠছেন না আমাদের দেশের গলদা ও বাগদা চিংড়িচাষিরা। গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ি সরবরাহ বৃদ্ধি বাংলাদেশের চিংড়ির দাম ও চাহিদা দুটোই কমিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু করার কোনো বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন: যেভাবে ভেস্তে যাচ্ছে ভেনামি চিংড়ি চাষের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০২০
এমআরএম/এজে