বরিশাল: বরিশালের বানারীপাড়া ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলায় পানিতে ভাসমান ধাপে চারা উৎপাদন ও সবজি চাষ বেশ জনপ্রিয় বহু বছর ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার নিম্নাঞ্চল অর্থাৎ বিলাঞ্চলে গত কয়েকবছর ধরে ভাসমান বেডে (ধাপ) সবজি চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
জলাবদ্ধ এলাকায় বেড বা ধাপে সবজির চাষ করে এলাকায় সবজির চাহিদা মিটিয়ে স্বল্প সময়ে এই প্রকল্পে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় এলাকার চাষিদের উৎসাহিত করে উপজেলায় এই চাষের সম্প্রসারণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বেশিরভাগ জমিতে পানি নিষ্কাশনের সু-ব্যবস্থা না থাকায় বছরের ছয় মাস এ অঞ্চলের জমিতে পানি জমা থাকে। তাই বছরে একবারই তারা জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন। বাকি সময় পানি জমে থাকার কারণে জমি থাকে অনাবাদি। বদ্ধ পানিতে আগাছা ও কচুরিপানায় ভরে যায় জমি।
সরকার চাষিদের আত্মকর্মসংস্থান ও পরিবারের আয়ের সুযোগ করে দিতে ২০১৩ সাল থেকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধিনে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে ‘বন্যা ও জলাবদ্ধ প্রবণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন অতিযোজন কৌশল হিসেবে ভাসমান সবজি ও মসলা উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। ওই প্রকল্পের আওতায় রাজিহার ইউনিয়নের বাশাইল গ্রামে চাষি সমন্বয়ে একটি সমিতির মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণদান, বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ, বেড তৈরির খরচ ও বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
কয়েক বছর আগে থেকেই বাশাইল গ্রামের চাষিরা বেড বা ধাপে সবজি উৎপাদন করে আসছিলেন। বিভিন্ন সহায়তা পাওয়ার পরে তাদের সঙ্গে অন্য এলাকার চাষিদেরও বেডে সবজি ও মসলা চাষে আগ্রহ বেড়েছে। বর্তমানে বাশাইল গ্রামে ৭০ হেক্টর বেডে সবজি ও মসলা চাষ হচ্ছে।
জানা গেছে, জমির বিকল্প হিসেবে মাঠের আগাছা ও খাল-বিলের কচুরিপানা ব্যবহার করে বেড বা ধাপ বানিয়ে ফসল উৎপাদন করতে উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের গোয়াইল গ্রামের বেশ কয়েকজনে নিজস্ব প্রযুক্তিতে ধাপের ওপর সবজি চাষ শুরু করেন।
প্রথম পর্যায়ে তাদের এই কাজকে অনেকেই ভালো চোখে না দেখলেও পরে স্বল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের কারণে এলাকার অনেকেই এখন ধাপের ওপর সবজি চাষ করছেন।
বাশাইল গ্রামের চাষি তোফাজ্জেল হোসেন জানান, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে বিভিন্ন জাতের সবজির চারা চাষের কার্যক্রম শুরু করা হয়। চাষিরা এ সময় বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কচুরিপানার বড় বড় দলকে একত্রিত করে রাখেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাতে পচন ধরে। পচন ধরা কচুরিপানাই ধাপ হয়। প্রতিটি ধাপেই পর্যাপ্ত জৈবসারের কারণে সবজির চারাগুলো অত্যন্ত উর্বর হয়।
অপর চাষি খালেক সরদার জানান, প্রত্যেকটি ভাসমান ধাপে চার বার চারা উৎপাদন করা যায়। প্রথমবার একমাস পরিচর্যার পর চারাগুলো বিক্রি করলেও পরবর্তীতে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই পুনরায় চারা বিক্রি করা যায়। করলা, বরবটি, সিম, পেঁপে, লাউ, কুমড়া, মরিচ, বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির চারাগুলো গ্রাম থেকেই পাইকাররা এসে মাদারীপুর, ফরিদপুর, চাঁদপুর, স্বরূপকাঠি, মাগুরা, ফেনীসহ স্থানীয় হাটবাজারের বিক্রি করা হয়।
এছাড়া চাষিদের তৈরি করা ধাপে সবজি বোনা হয়। যারমধ্যে রয়েছে লালশাক, পুঁইশাক, ডাটা, মরিচ, করলা, ঢেঁড়শ, হলুদ, শসা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ। আর এসব উৎপাদন ও বিক্রির মাধ্যমে উপজেলার বাশাইলসহ তিনটি গ্রামের বেশ কিছু পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। বর্তমানে উপজেলার দক্ষিণ নাঘিরপাড়, চাঁদত্রিশিরা, বাগধা, পার্শ্ববর্তী উজিরপুরের সাতলা, জল্লাসহ আশপাশের গ্রামের চাষিরাও ধাপের ওপর সবজি ও চারা আবাদে ঝুঁকছেন।
সার্বিক বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, ধাপের ওপর সবজি চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাদের বিনামূল্যে বীজ, সারসহ বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হয়। উপজেলার বাশাইলে ২৫জন চাষিদের এই প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিলো। তারা সবাই বেডে চারা উৎপাদন করে বর্তমানে ভালো আয় আসে। এখন ২৫ জনের বাইরে অনেকে নিজ উদ্যোগে বেডে চারা উৎপাদন করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২০
এমএস/এএটি