বরিশাল: দক্ষিণাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিলে সারাবছর ধরেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে মৎস্যজীবীরা। তবে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরার আয়োজনটা হয় বড় পরিসরে।
এসব ফাঁদ বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় গ্রামগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে। তবে লাভ-লোকসানের হিসাব কষে অনেকেই যেমন ছেড়েছেন ফাঁদ তৈরির কাজ, আবার অনেকেই নতুন করে করেছেন শুরু।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার মোহনকাঠি গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার এই চাঁই তৈরি করে। গ্রামটিকে অনেকেই চাঁইপল্লী হিসেবে ডাকতে শুরু করেছেন। নানাবিধ সংকট আর সমস্যার মধ্যে ওই গ্রামের কয়েকশ পরিবার এখনো বংশ পরম্পরায় চাঁই তৈরি পেশা হিসেবে রেখেছেন। শুধু মোহনকাঠি নয়, উপজেলার বারপাইকা গ্রামের শতাধিক পরিবারও রয়েছে একই পেশায়। তবে চাঁই তৈরির কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমাণটা কমে গেছে। এ নিয়ে অনেকেই হতাশার মধ্যে দিন পার করছেন। অনেকে পেশা বদল করলেও সরকারি উদ্যোগে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পেলে বাপ-দাদার কাছ থেকে শেখা এই কাজ টিকিয়ে রেখে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার স্বপ্ন দেখছে এই কুটিরশিল্পের বেশিরভাগ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিনিয়ত চাঁই তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ, বেত ও লতার মূল্য বাড়ছে। প্রধান উপকরণের দাম বাড়লেও তৈরি চাঁইয়ের বাজারদর সেভাবে বাড়েনি। তাই সবমিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাঁইয়ের কারিগররা। ফলে অর্থসংকটের মধ্যে চাঁই তৈরির কারিগরদের এখন মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি কেউ এনজিও ও গ্রাম্যসুদি মহাজনদের কাছ থেকে টাকা এনে এ ব্যবসা করছেন।
মোহনকাঠি গ্রামের চাঁই তৈরির কারিগর সচীন বৈরাগী জানান, তার বাবা, ঠাকুর দাদাসহ তাদের পূর্বপুরুষরা এ চাঁই তৈরির পেশায় ছিলেন। চাঁই তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে তলা বাঁশ, বেত ও কৈয়া লতা। বতর্মানে বেত দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় বাঁশ ও লতা দিয়েই চাঁই তৈরি করা হয়। কুয়াকাটা, চট্টগ্রাম, কাপ্তাইসহ পাহাড়ি অঞ্চল থেকে পাইকাররা কৈয়া লতা কিনে আনেন। কিন্তু নানান অজুহাতে বছরে বছরে এ লতা আর বাঁশের দর বাড়ছে।
তবে উজ্জ্বল নামে অপর এক কারিগর জানান, যে ধরনের বাঁশ দিয়ে চাঁই-বুচনা-গড়া তৈরি করা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বাঁশের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন অনেকটা বেগ পেতে হয় তা যোগাড় করতে। এ কারণে বাঁশের দাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। আর বাড়তি দামে কাঁচামাল সংগ্রহ করে চাঁই বানিয়ে যখন বিক্রি করা হয় তখন বিগত সময়ের চেয়ে দরের তেমন একটা তারতম্য হচ্ছে না। তাই কারিগরদের দিনও ভালো যাচ্ছে না। সংসার চালাতে গিয়ে অর্থসংকটেও পড়তে হচ্ছে তাদের। সেক্ষেত্রে মহাজন, গ্রাম্যসুদি নয়তো ঋণদাতাদের কাছে ছুটতে হচ্ছে। কারিগরদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্ষা মৌসুমে চাঁইয়ের কদর বেশি থাকায় সেসময় এর কাজ বেশি হয়। তবে মৌসুম গেলে অনেকটা সময় বেকার থাকতে হয় তাদের। মৌসুমে পাঁচ দিনে এক কুড়ি চাঁই একজন শ্রমিক তৈরি করতে পারেন। যদি সেসব চাঁই শ্রমিকরা পাইকারি হিসেবে বিক্রি করেন, তাহলে এক কুড়ি চাঁইয়ে দাম পেতে পারেন ৫-৬ হাজার টাকা, যদিও এগুলো খুচরো বাজারে বিক্রি হয় প্রায় দ্বিগুণ দামে। আর তাতে কারিগরদের থেকে বেশি লাভবান হন পাইকাররা।
বরিশালের মাহিলার হাটের ক্রেতারা বলছেন, পানি বাড়ার কারণে চাঁই-বুচনা-গড়ার চাহিদা বেড়েছে। কদর বাড়ায় গতবারের চেয়ে এবার এর দাম বেশি বলেই মনে হচ্ছে।
তবে কারিগররা বলছেন, এখন পর্যন্ত যে দরে এসব মাছ ধরার ফাঁদ বিক্রি হচ্ছে তাতে পণ্য আর শ্রম মিলিয়ে তেমন একটা লাভ হচ্ছে না তাদের।
যদিও গত দুই হাট ধরে মাহিলার, পয়সারহাটে চাঁই-গড়া-বুচনার বিক্রি ভালোই হচ্ছে বলে দাবি পাইকারদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০২০
এমএস/এএ