কুষ্টিয়া: করোনাকালীন কাজ হারিয়ে কুষ্টিয়ার যুবক, ছাত্র, তরুণ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, স্কুল শিক্ষক, শ্রমিক ও যুবকদের অনেকেই সাফল্য পেয়েছেন হাঁসের খামার পালন করে।
কম সময়ে অধিক লাভ পেয়ে তারা বেশ খুশি।
স্থানীয়দের মতে, বেকার অলস সময়কে কাজে লাগাতে পারলে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়াও রোধ হবে সামাজিক অবক্ষয়।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের নিমতলা এলাকার জিহাদ আলী। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। করোনার শুরুতে অন্য দোকানের মতো বন্ধ টানা প্রায় দুই মাস বন্ধ ছিলো তার কাঠের দোকানও। অভাবের সংসার, তার উপরে কাজ নেই। একসময় বাড়ি থেকে পরিবার নিয়ে চলে আসে শ্বশুরবাড়ি পাশ্ববর্তী গ্রাম কচুবাড়িয়াতে। সেখানে এসে হাঁস-পালন শুরু করে। মাত্র দুই মাসেই সাফল্য পেয়েছেন তিনি। ছোট্ট হাঁসের খামারটি এখন বেশ বড় করছেন। তার সাফল্য দেখে আরও দুইজন হাঁসের খামার করছেন।
জিহাদ আলী বাংলানিউজকে জানান, করোনার শুরুতে খুব কষ্ট করেছি। কাজ নেই, বাড়িতে বসে থাকা। মাঠের কাজও পারিনা। তারপর একদিন অনলাইনে হাঁস পালন দেখি। সেখানে কিভাবে খামার করতে হয় সেটা দেখলাম। ঠিক করলাম আমিও হাঁসের খামার করবো। তবে হাঁস পালন সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিলো না। যেটুকু ছিলো সেটা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। পরে মিরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সোহাগ রানার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি হাঁসপালন সম্পর্কে বিস্তারিত জানান।
তিনি বলেন, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বামুন্দি থেকে মাত্র এক দিনের ৪৫০টি খাকি ক্যাম্বেল জাতের নারী (মহিলা) হাঁসের বাচ্চা নিয়ে আসি। যার প্রতিটির দাম নিয়েছিলো ৩৫ টাকা। প্রথমে মাত্র ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আমি হাঁসের খামারের শুরু করি। এর মধ্যে হাঁসের ঘর তৈরি করতে খরচ করি ৩৫ হাজার টাকার এবং বাচ্চা কিনে আনতে খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। হাঁসের বাচ্চাকে প্রথমে ফিড খাবার খাওয়াতাম। তারপর দিনে মাঠে চরাতাম যাতে খাবার কম লাগে এবং দ্রুত বড় হয়। এখন গম, ভুট্টা, ধান, ধানের কুড়া, খুদ এসব খায়।
মাত্র দুই মাস আটদিন বয়স এখন আমার খামারের হাঁসের। এখন বাজারে বিক্রি করতে গেলে ২৫০-৩০০ টাকা করে বিক্রি হবে। সাড়ে চার মাসে হাঁসগুলো ডিম দেওয়া শুরু করবে। একটি খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁস প্রায় সারাবছর ডিম দেয়। হাঁসের পরিচর্যার মধ্যে সাতদিন বয়সে ডাক কলেরা, ২১-৪৫ দিন বয়সে ডাক প্লেগ রোগের টিকা দিয়েছি। হাঁস পালন খুবই লাভজনক। যেকোনো চাকরি বা ব্যবসার চেয়ে খুবই কম সময়ে লাভবান হওয়া যায়।
জিহাদ আরও বলেন, খামারটায় এখন হাঁসগুলো খুবই কষ্ট করে। আর ভাবছি আরও হাঁসের বাচ্চা আনবো। কিন্তু টাকার জন্য হয়ে উঠছে না। লোনের জন্য কৃষি ব্যাংকে গিয়েছি। কিন্তু জমির কাগজ না থাকায় লোন দেয়নি। বাড়ির জমি ছাড়া তো মাঠে কোনো জমি নেই। খামার দেখেও লোন দিলো না।
জিহাদের এ সাফল্য দেখে তার কাছ থেকে হাঁস পালন পদ্ধতি জেনে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নিমতলা এলাকার আরও দুই বেকার যুবক। তারা হলেন সানারুল ও রিপন। ইতোমধ্যে হাঁসের খামার তৈরি করেছেন তারাও। শুরুতে ২০০ করে হাঁসের বাচ্চা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
চিথলিয়া এলাকার যুবক সাগর আহম্মেদ। এইচএসসি পাস করেছেন। বর্তমানে করোনার কারণে কলেজ বন্ধ রয়েছে। এই সুযোগটা বাড়িতে বসে না থেকে হাঁসের খামার করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, হাঁস খুবই দ্রুত বাড়ে। আর করোনার এই সময় বাড়িতে বসে না থেকে হাঁস পালন করা খুবই লাভজনক। আমি তিন মাস আগে ৩৫ টাকা পিস হিসাবে হাঁসের বাচ্চা কিনেছি। এখন সেগুলো দাম ৫০০ টাকা জোড়া।
তিনি আরও বলেন, হাঁসের খামারিরা অনেকেই অর্থ সংকটে ভোগেন। সরকারি আর্থিক সহায়তা পেলে বা স্বল্প সুদে ঋণ পেলে আমাদের খুবই ভালো হয়।
মিরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় মোট হাঁসের খামার রয়েছে ৫৭টি। খামার এবং বাড়িতে প্রায় ৭৬ হাজার হাঁস পালন করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে উপজেলায় ৩৩টি হাঁসের খামার ছিলো। যেখানে খামার এবং বাড়িতে প্রায় ৪১ হাজার হাঁস পালন করা হয়েছিল। এ বছর রেকর্ড পরিমাণে হাঁসের খামার বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. সোহাগ রানা বাংলানিউজকে জানান, হাঁস পালন খুবই লাভজনক। মুরগি পালনের চেয়ে হাঁস পালনে সুবিধা অনেক বেশি। বিশেষ করে খামারিদের পছন্দ খাঁকি ক্যাম্বেল হাঁস। এ জাতের একটি হাঁস বছরে ২৮০-৩০০ ডিম দেয়। বর্তমানে মিরপুর উপজেলার কর্মকহীন যুবক ও বেকাররা বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন এই হাঁস পালনে। করোনাকালীন সময়ে কর্মহীন ও যুবকরা অনেকেই হাঁসের খামার করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। আমরা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে খামারিদের খামার সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করছি। তাদের পরামর্শ দিচ্ছি। সেই সঙ্গে হাঁসের বিভিন্ন রোগের টিকা সর্বারহ করি।
কর্মক্ষম ছাত্র-যুবক বা করোনাকালীন সংকটে কর্মহীন হয়ে পড়া যুবকরা হতাশ না হয়ে হাঁস ও গবাদিপশু পালন করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবেন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০
এনটি