ঢাকা: করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতি স্থবির হওয়ার সঙ্গে যখন ব্যাংকিং খাতও আক্রান্ত, ঠিক তখনই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকগুলো।
এসব উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং, যা চলমান মন্দার মধ্যে গতি অর্জন করেছে।
ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম শুরু না হলেও ডিজিটাল ব্যাংকিং চ্যানেল (এজেন্ট ব্যাংকিং) দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চালে পৌঁছাতে পেরেছে, যা চলমান করোনা মহামারির সংকট থেকে দেশকে তুলে আনতে পারে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ঋণ গ্রহীতাদের মাঝে ঋণ বিতরণ এবং ভবিষ্যতে আমানত সংগ্রহ করতে পারে।
চলতি বছরের জুন শেষে এজেন্ট কার্যক্রম পরিচালনাকারী ২৩টি ব্যাংকের হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৩ লাখ ৫৮ হাজার। এসব হিসাবের ৮৭ শতাংশই গ্রামের মানুষের। বাকি ১৩ শতাংশ শহরাঞ্চলের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিসাবের সংখ্যা তিন মাস আগের তুলনায় ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এক বছর আগের তুলনায় ১১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যাংকগুলো এখন এজেন্ট ব্যাংকিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ এবং প্রবাস থেকে পাঠানো রেমিটেন্সের অর্থ প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুন শেষে আমানতের পরিমাণ ৯৩ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণও একই সময়ে ২০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২০ কোটি টাকা। একই সময়ে রেমিটেন্স এসেছে ২৬ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আরও প্রশস্ত করার অংশ হিসেবে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগণকে সেবার আওতায় আনার উদ্যোগ হিসেবে ২০১৩ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশ্ব ব্যাংকের মতে, করোনা মহামারির আগে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিকাশ অগ্রাধিকার থাকলেও এখন স্বল্প মেয়াদী সহায়তার অর্থ বিতরণ, বিস্তৃত আকারে টেকসই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সবার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ডিজিটাল আর্থিক সেবা ত্বরান্বিত করতে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে ঝুঁকি কমাতে কীভাবে ক্রমবর্ধমানভাবে এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা যায় সেটাও ভাবতে হবে।
এ বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী বলেন, ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দ্রুত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করতে পারে।
এজেন্ট ব্যাংকিং ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান। এটি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সহায়তা, কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ, ভর্তুকির অর্থ অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।
আরফান আলী আরও বলেন, অপরদিকে গ্রামের মানুষ দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিংখাতে আমানত রাখতে এটা তাদের উৎসাহী করছে। এজেন্ট ব্যাংকিং উইন্ডো গ্রামের মানুষকে ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিংয়ের অধীনে সর্বোত্তম আর্থিক পরিষেবা সরবরাহ করে আসছে।
এজেন্ট ব্যাংকিং মডেলটি জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ব্যাংক এশিয়া উইন্ডো দিয়ে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম বাড়ানোর কথা ভাবছে।
এজেন্ট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বর্তমানে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের অর্থের হিসাব পরিচালনা করছেন, যা সামনের দিনগুলোতে আরও বড় আকারে বৃদ্ধি পাবে বলে জানান আরফান আলী।
এজেন্ট ব্যাংকিং উউন্ডোর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ক্রয় এবং বিক্রয়ের অর্থ প্রদান করেন।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণকৃত ৭২০ কোটি টাকার ঋণের ৩৮শতাংশই বিতরণ করেছে ব্যাংক এশিয়া। অদূর ভবিষ্যতে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম আরও প্রসারিত করবে ব্যাংকটি।
ব্যাংকগুলো সেবা প্রদানের জন্য কমিশন দেওয়ার কারণে এজেন্টরাও ব্যবসা সম্প্রসারণে উৎসাহী হচ্ছে।
ঋণ বিতরণে ১ শতাংশ, আমানত সংগ্রহে ২ শতাংশ এবং রেমিটেন্সের অর্থ প্রদানের জন্য এজেন্ট পাচ্ছেন ৫০ টাকা।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আরেক শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ডাচ-বাংলা ব্যাংকের (ডিবিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাবে।
তিনি বলেন, কোনো কোনো শাখা পরিচালনা করতে ব্যাংকগুলোর প্রতি মাসে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। শাখার তুলনায় ব্যাংকগুলোকে এজেন্ট ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে আমানত সংগ্রহের জন্য এখন স্বল্প পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, যা ঋণ বিতরণের একই পরিমাণ।
গ্রাহক এখন ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে এজেন্টের কাছ থেকে ই-কেওয়াসির মাধ্যমে হিসাব খুলতে পারছেন, যা জনগণকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দিকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে।
তিনি আরও বলেন, মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে ব্যাংকিং পরিষেবা সুচারুভাবে পেতে সহায়তা করেছে। সুতরাং, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার গতি বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিচ্ছে।
এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আরও দুটি ব্যাংক সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পেয়েছে। সবমিলিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবাদানকারী ব্যাংকের সংখ্যা এখন ২৮টি। বর্তমানে ২৩টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এসব ব্যাংকের ৮৭৬৪টি মাস্টার এজেন্টের মাধ্যমে ১২ হাজার ৪৪৯টি আউটলেটের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এজেন্টের মাধ্যমে রেমিটেন্স গ্রহণ, টাকা জমা, উত্তোলন ও হিসাব খোলা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০
এসই/এমএইচএম