মৌলভীবাজার: সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান। শহরের দমবন্ধ হওয়া কোলাহল থেকে বের হয়ে দিগন্তের দিকে চোখ পড়লেই দেখা যায় নানা ধরনের কৃষির ছড়াছড়ি।
এসব কৃষির জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি সরীসৃপ প্রাণীর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। মানুষ না জেনে অকারণে মেরে ফেলছে এই প্রাণীকে। দেখা মাত্রই যেন তাকে মেরে ফেলতে হবে! এমন ভয়ঙ্কর মানসিকতায় অবলীলায় মরছে কৃষিবান্ধব সাপ।
এমন সর্পপ্রজাতির বিরল একটি সাপের নাম ‘লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপ’। ইংরেজিতে একে বলে Red-necked Keelback (Rhabdophis subminitus)।
কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম এলাকা থেকে সাপের কিছু ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী সাঈদ বিন জামাল। এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণী বিষয়ক এ আলোকচিত্রী বাংলানিউজকে বলেন, বেশির ভাগ মানুষেরই সাপ সম্পর্কে জ্ঞান নেই। মানুষ মনে করে সাপ মানেই বিষাক্ত। বিষাক্ত এবং নির্বিষ (বিষমুক্ত) সাপ সম্পর্কে মানুষ জানার চেষ্টাও করে না। সাপ দেখলেই চমকিয়ে ওঠে! মূলত সচেতনতা এবং শিক্ষার অভাবের কারণেই মানুষ সাপ মারছে।
তিনি বলেন, কৃষি এবং পরিবেশের উপকারী একটি প্রাণী সাপ। বিশেষ করে কৃষকদের জন্য সাপ অনেক উপকারী। ধানক্ষেতের ক্ষতিকর ইঁদুর এবং পোকা দমনের ক্ষেত্রে সাপের ভূমিকা অগ্রগণ্য। একটা জায়গায় সাপ না থাকার মানে হচ্ছে ওই জায়গায় ক্ষতিকর ইঁদুর এবং পোকামাকড় বেড়ে যাওয়া।
‘এখন কথা হলো, আপনার বাড়ির ভেতর কেউ প্রবেশ করলে আপনি তো তাকে বাধা দেবেন তাই না? সাপের আবাসভূমি ধ্বংস করে আপনি পা দিচ্ছেন তার উপরে, তখন সে তো আত্মরক্ষার্থে আপনাকে আঘাত করবেই। কারণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রত্যেকটা প্রাণীরই রয়েছে। ’
লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপ সম্পর্কে সাঈদ জামাল বলেন, এই সাপের অপর বাংলা নাম লাল-গলা ঢোঁড়া সাপ। বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর একটি সাপের প্রজাতি। এদের দেহ জলপাই-বাদামি বা সবুজাভ, গ্রিবা সিঁদুরের মতো লাল। লেজসহ সাপটির দৈর্ঘ্য ৭৫ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি বনাঞ্চলের খাল-বিল, ঝিরি বা পুকুরের আশপাশে এদের দেখা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে। ’
বিষাক্ততার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সাপটি বিষাক্ত না-কি নির্বিষ এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, তবে বর্তমানে এদের Venomous Snake (বিষাক্ত) হিসেবেই ধরা হয়। এদের সত্যিকার অর্থে বিষদাঁত নেই, তবে মাড়িতে পেছনে খাঁজকাটা দাঁত আছে যা দিয়ে বিষ প্রয়োগ করে থাকে। এই সাপের বিষ অন্যান্য সাপের বিষের মতো Neurotoxic, Haemotoxic বা Cytotoxic নয়, এদের বিষ কিডনিকে অকার্যকর করে দেয় এবং এই বিষের অ্যান্টিভেনম বিরল। এছাড়া এদের ঘাড় থেকে এক ধরনের বিষাক্ত তরল নিঃসৃত হয়। যা শিকার ধরতে ব্যবহৃত হয়। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর জন্যও এই তরল ক্ষতিকর। এদের লালারসও বিষাক্ত হয়। এদের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড আছে।
তিনি আরো বলেন, এমনিতে শান্ত ও নিরীহ স্বভাবের। তবে দিনের বেলায় এরা সক্রিয়। প্রজনন কাল জুন-জুলাই। খাদ্য হিসেবে ব্যাঙ, টিকটিকি, ইঁদুর ও অন্যান্য ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবনধারণ করে। ক্ষতিকর ইঁদুর ও কীটপতঙ্গ খাওয়ার জন্য এরা পরিবেশ ও কৃষকদের জন্য একটি উপকারী সরীসৃপ। এদের দেখতে পেলে অযথা আতঙ্কিত হয়ে হত্যা না করে নিজের মতো চলে যেতে দিলে মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) লাল তালিকা অনুযায়ী, এরা সংকটাপন্ন। এক সময়ে এদেশে সুলভ এই সৌন্দর্যময় সাপটি হত্যা এবং আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে বর্তমানে লাল-ঘাড় ঢোঁড়া সাপ প্রজাতিটি মারাত্মক হুমকির মুখে বলে জানান সাঈদ জামাল।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২০
বিবিবি/টিএ