সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে ফিরে: কয়েক বছর আগেও পেটের তাগিদে সুন্দরবন তীরবর্তী দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে কাজ করতো শিশুরা। জেলে-মহাজনদের অর্থের লোভে পড়ে অভিভাবকরাও শিশুদের বঙ্গোপসাগরের চরাঞ্চলে পাঠাতেন।
একদিকে অক্লান্ত পরিশ্রম, অন্যদিকে সামান্য ভুলের কারণে তাদের নির্মম-নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু এখন সে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে কমেছে শিশুশ্রম।
সম্প্রতি সরেজমিনে দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে, চলতি শুঁটকি মৌসুমকে ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের দুবলার চরের জেলেপল্লি। এখন পুরোদমে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শুরু হয়েছে। সমুদ্র থেকে মাছ এনে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করছেন হাজার হাজার জেলেরা। কিন্তু এদের মধ্যে শিশু শ্রমিক নেই বললেই চলে। অনেকটা শিশুশ্রম মুক্ত দেখা গেছে স্থানটিকে। শুঁটকি পল্লির রবিউলের ঘরে কাজ করার সময় কথা হয় ইমনের সঙ্গে (১৩)। ওই কিশোর জানায়, তার গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছার মাহমুদ কাঠি গ্রামে। সম্পর্কে চাচা হয় তার সুবাদে এখানে কাজে এসেছে। তবে তার বয়সী তেমন শিশু এখানে নেই বলে জানায় সে।
বঙ্গোপসাগর উপকূলে দুবলারচর, আলোরকোল, নারকেল বাড়ীয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চর নিয়ে সুন্দরবনের সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক মাছ শুঁটকিপল্লি কেন্দ্র দুবলার অবস্থান। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে এ চরগুলো অবস্থিত।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আর এবার শুঁটকিখাত থেকে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। গত ২০১৮-১৯ শুঁটকি আহরণ মৌসুমে জেলেদের আহরিত ৪১ হাজর ৫৪ কুইনন্টাল শুঁটকি থেকে বন বিভাগ ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ মৌসুমে ৪৪ হাজর ৭১৩ কুইনন্টাল শুঁটকি থেকে বন বিভাগ ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। জানা যায়, সমুদ্রের লোনা পানি আর রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনি যেন দুবলার চরের শিশুদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে প্রতিবছর অন্তত ছয়মাসের জন্য আনা হতো এসব শিশুদের। এই পরিশ্রমের জন্য এক মৌসুমে তারা মজুরি হিসেবে পেত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। অর্থের অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিশুরাই বেশি আসতো এখানে। এখানে আসার পর মাছ শুকানো থেকে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত সব ধরনের কাজই তাদের করতে হতো।
শিশুশ্রম বন্ধে এনজিও ও কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের তৎপরতা, শিশুদের উন্নয়ন ও কল্যাণে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই, শিক্ষা-উপকরণ বিতরণসহ উপবৃত্তি দেওয়ায় শিশুশ্রম কমে আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালুর কারণেও শিশুশ্রম কমছে বলে বলছেন কেউ কেউ।
শুঁটকি ব্যবসায়ী দেবু বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পযর্ন্ত চলে এ অস্থায়ী পল্লিতে মাছ শুঁটকির কাজ। নির্ধারিত রাজস্ব দিয়ে অস্থায়ী শুঁটকি পল্লিতে অস্থায়ী ঘর করে সামুদ্রিক মাছ আহরণ করে জেলেরা। আগে এসব জেলে-মহাজনেরা শিশুদের এনে শ্রম দেওয়া তো। এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
শুঁটকি পরিবহন প্রতিষ্ঠান খান শফিউল্লাহ ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার কুতুব উদ্দিন মোল্লা বলেন, এখন দুবলার চরে শিশু শ্রমের পরিমাণ নেই বললেই চলে। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এখানে দুই একজন যেসব শিশু রয়েছে তারা জেলেদের সন্তান। বাবার সঙ্গে এসে এখানে কাজ করছে।
বেসরকারি সংস্থা প্রদীপনের নির্বাহী পরিচালক মো. ফেরদৌসুর রহমান বলেন, শিশুশ্রম বন্ধে এনজিওর মধ্যে আমরাই প্রথম এবং একমাত্র দুবলার চরে কাজ করেছি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দরিদ্র ঘরের শিশুদের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দুবলার চরে নিয়ে যাওয়া হতো। আবার কোনো কোনো পরিবার স্বেচ্ছায় শিশুদের কাজে দিতো। দীর্ঘ বছর ধরে শুঁটকি আহরণ মৌসুমে স্বল্প বেতন আর বেশি মুনাফা লাভের আশায় এসব চরে থাকা জেলে-বহরদ্দারদের কাছে শ্রমিক হিসেবে বেশি কদর এসব শিশুদের। কিন্তু এখন তার পরিবর্তন হয়েছে। দুবলার চর থেকে শিশু শ্রম কমে আসছে। প্রায় ১ যুগ আগে বনবিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশের সিদ্ধান্ত ছিলো ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশু দুবলার চরে না যায়। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতিবছরই দুবলার চরে আসাদের মধ্যে শিশু আছে কিনা তা চেক করা হয়।
পরিবর্তন খুলনার নির্বাহী পরিচালক এম নাজমুল আজম ডেভিড বাংলানিউজকে বলেন, শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনের বিভিন্ন তৎপরতা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর ভূমিকার কারণে দুবলার চরে শিশুশ্রম কমেছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের গোয়েন্দা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মাজহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের কারণ ও দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে বিগত দিনের অভিযানের কারণে শিশুশ্রম কমে এসেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
এমআরএম/এএটি