ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

হচ্ছে না হালখাতা, ব্যবসায়ীদের অর্ধেক পুঁজি ঝুঁকিতে

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২১
হচ্ছে না হালখাতা, ব্যবসায়ীদের অর্ধেক পুঁজি ঝুঁকিতে

ঢাকা: একদিন পরই পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ ১৪২৮-এর প্রথম দিন।

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হালখাতা খোলার দিন। পুরনো হিসাব চুকিয়ে লাল মলাটের নতুন টালি খাতায় হিসাব লিপিবদ্ধ করার দিন। যুগ যুগ ধরে এমনটাই চলে এলেও করোনা মহামারির জন্য লকডাউন থাকায় দ্বিতীয়বারের মতো হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারছেন না পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ৫০ শতাংশ পুঁজি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার ও শাঁখারিবাজারের জুয়েলার্স ও অলংকার তৈরির কারখানা, শ্যামবাজার, চকবাজার ও মৌলভীবাজারের আড়ত এবং ইসলামপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হালখাতা উৎসবকে ঘিরে যে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের দম ফেলার সময় থাকতো না তারা আজ কর্মহীন দিন পার করছেন। করোনার ভয়াবহ থাবা যেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের স্বপ্নকে গ্রাস করে ফেলেছে। হালখাতার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার কোনো প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। বছরের শেষ দিনে ধোয়া-মোছা থেকে শুরু করে দোকান সাজানো, রং করা, নতুন টালি খাতা কেনা, শীতলপাটি কেনার কোনো আগ্রহ ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা যায়নি। ফলে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি বেচা কেনা হওয়া মঙ্গল ঘট, বেলুন, সোলার ফুল, মালা, নতুন শীতল পাটি, টালিখাতা, কার্পেট ব্যবসায়ীদের বেকার বসে থাকতে দেখা গেছে। আগের মতো টালি (লাল রঙের হিসাবের খাতা) বিক্রেতাদের খাতা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়নি। শীতল পাটি বিক্রেতাদের আনাগোনা কম দেখা গেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি দিলীপ কুমার আগরওয়াল বাংলানিউজকে বলেন, করোনা ভাইরাসের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো দেশের কোথাও কোন জুয়েলারিতে হালখাতার অনুষ্ঠান হচ্ছে না। জুয়েলারি শিল্পের সঙ্গে হালখাতার একটা বিরাট সম্পর্ক আছে। সারা বছর আমাদের কাস্টমাররা বকেয়া নেয় আর বৈশাখে এসে সেটা পরিশোধ করে। এ সুযোগটা এবারও আমরা হারালাম। গত বছর আমরা বৈশাখ ও ঈদ পাইনি। এবারও আমরা বৈশাখতো পাবই না, ঈদের বাজারও ধরতে পারবো কিনা জানি না।

তিনি বলেন, সারা দেশে তালিকাভুক্ত প্রায় ১৭ হাজার ৫০০ স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন। বৈশাখ বা হালখাতা করতে না পারায় আমাদের পুঁজির ৫০ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে বা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যাবে। আমাদের মোট ব্যবসার ২৫ শতাংশ আসে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে, ২৫ শতাংশ আসে বৈশাখে, ২৫ শতাংশ আসে ঈদে ও সারা বছর আসে ২৫ শতাংশ। সেখান থেকে আমাদের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে করোনার কারণে। গতবছর আমাদের ৭০ শতাংশ ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। গতবছরের ব্যবসায়ীক লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে আবার আরেকটা ধাক্কা। গত বছর আমাদের ১২০০ থেকে ১৩০০ ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।

ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ইসলামপুরে কাপড় কিনতে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা আসেন। পহেলা বৈশাখ ও রোজার সময়ই তারা বেশি আসেন। তাই অধিকাংশ বকেয়া ওই সময়ই আদায় হয়। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে কোথাও হালখাতা হবে না। ফলে বকেয়া আদায়ও অনিশ্চিত। গত বছরের অনেক বকেয়া এখনও আদায় হয়নি। তার মানে আমাদের প্রায় ৫০ শতাংশ বকেয়া অনিশ্চয়তার মুখে। গতবছর আমাদের ১০ শতাংশ ব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। এ বছর ধারণা করছি করোনা পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তাহলে সব মিলে ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী হারিয়ে যাবে।  

তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মাধব পাল বাংলানিউজকে বলেন, ক্রেতারাই আমাদের লক্ষ্মী। সারা বছর যারা বাকিতে স্বর্ণালঙ্কার কেনেন তারা পহেলা বৈশাখে প্রায় সব টাকা পরিশোধ করেন। প্রতিবছর কার্ড ছাপিয়ে ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে হালখাতা করে থাকি। কিন্তু গতবারের মতো এবার হালখাতা হচ্ছে না। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই ব্যবসায়ীদের মধ্যে আনন্দ নেই।

ফেনী থেকে আসা শীতল পাটি বিক্রেতা মিন্টু মিয়া বাংলানিউজকে জানান, গত ১০ বছর ধরে তিনি তাঁতিবাজারে শীতল পাটি বিক্রি করেন। প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৬০০ শীতল পাটি আনেন। কিন্তু এবার তিনি মাত্র শখানেক পাটি বিক্রি করতে পেরেছেন।

চকবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার কারণে সরকারের নির্দেশ মেনে হালখাতা করছেন না তারা।

উল্লেখ্য, সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তাই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। অতীতে জমিদারকে খাজনা দেওয়ার অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পুণ্যাহ’ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় পুণ্যাহ বিলুপ্ত হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২১
জিসিজি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।