ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানির বিকল্প নেই 

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২২
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানির বিকল্প নেই 

ঢাকা: সরকারি গুদামে যথেষ্ট চালের মজুদ রয়েছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরবরাহও ভালো রয়েছে।

তারপরও বাজারে কমছে না দাম। উল্টো দিন দিন চালের দাম মিলগেট, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বেড়েই চলেছে। দামের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ভোক্তাদের তিন বেলার খাবার যোগাতেই তুলেছে নাভিশ্বাস। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতিকেজি চালের দাম ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামী এক মাসে চালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। আর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধে সরকারকে এ বছর দেড় থেকে দুই মিলিয়ন টন চাল আমদানি করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ মিল থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় কঠোর নজরদারি করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ধানের চেয়ে চাল বেশি কেনায় মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে বড় ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো বাজারে আসায় চালের মজুদ বেড়েছে। মিলাররা সরকারি গুদামে চাল দিলেও খোলাবাজারে সঠিকভাবে সরবরাহ করছে না। ইচ্ছামতো সরবরাহ করে বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। আবার এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চাচ্ছেন দেশে চাল আমদানি হোক। এজন্য দাম বাড়িয়ে বাজারে চাপ তৈরি করছেন। এ দাম কমাতে বাজার তদারকির বিকল্প নেই।

এছাড়া বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ ভোক্তা চিকন ও মাঝারি ধরনের চাল খায়। এ চাল উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। গত বোরো মৌসুমের ধান-চালের মজুদ প্রায় শেষ। ফলে সরবারহ কম। এজন্য সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর হতে হবে। মিল থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় কঠোর নজরদারি করতে হবে, বর্তমানে যা খুবই দুর্বল। এছাড়া ওএমএসর কার্যক্রম বাড়লে দাম কমে আসবে বলেও জানান তারা।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, চালের দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধে সরকারের এ বছর দেড় থেকে দুই মিলিয়ন টন চাল আমদানি করতে হবে। সরকারকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সরকার আমদানি করা চাল আনতে পারবে তত বেশি মঙ্গল হবে। তাহলে দাম কম বাড়বে।

তিনি বলেন, সরকারের মজুদ আছে, কতো মজুদ আছে সেটা আপনি ও আমি জানি না। ফলে সেটা বলে লাভ নেই। গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজার কি বলছে। বাজারে যদি চালের সংকট না থাকে তাহলে দাম বাড়ছে কেন। তাহলে সরকারের দুর্বলতা রয়েছে। এ মুহূর্তে দাম কমাতে হলে আমদানর কোন বিকল্প নেই।  

এছাড়া মিল মালিকরা ধান কিনে বলেই আমরা সারা বছর চাল পাচ্ছি। তবে সরকারকে নজর রাখতে হবে। মিল মালিকরা যেন প্রয়োজনে অতিরিক্ত মজুদ না করতে পারে। মিলাররা বাজারকে স্থিতিশীল রাখে। যখন বাজারে ঘাটতি থাকে তখন সরকারের উচিত সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। ফলে সরকারকে আমদানি করে বাজারের ঘাটতি মিটাতে হবে।

বাবুবাজারের পাইকারি আড়তের রশিদ রাইস এজেন্সির মালিক আব্দুল রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, এখন চালের মৌসুম না। আগামী মার্চ মাসের শেষে নতুন চাল আসবে। এদিকে গত অগ্রহায়ণ মৌসুম শেষ হয়েছে। মাঝের দুই মাস সব সময় চালের সংকট থাকে। কিন্তু এ বছর চালের সরবরাহ ভালো রয়েছে। তারপরও চালের দাম কেন বাড়ছে বলতে পারছি না। তবে আমার ধারণা এবছর ধানের দাম বেশি, কৃষকের কাছে ধান নেই। ফলে মিল মালিকরা এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। এছাড়া চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) বন্ধ হলে চালের দাম বেড়ে যায়। আবার এলসি চালু হলে স্বাভাবিক হয়। তাই সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে চালের এলসি চালু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে মিলগেটে নজরদারি বাড়াতে হবে।

একই বাজারের দয়াল ভাণ্ডারের ম্যানেজার মো. সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, গত ১৫ দিনের ব্যবধানে সব রকমের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। বাজারে প্রচুর সরবরাহ রয়েছে, কোথাও চালের সংকট নেই। শুধু ক্রেতার সংকট। তারপরও চালের দাম কেন বাড়ছে মিল মালিকদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন, বাজারে ধানের সংকট, দাম বেড়েছে তাই চালের দামও বেড়েছে। একই সঙ্গে পরিবহন ব্যয়, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজিতো আছেই। সরকার এবিষয়ে সব জানে তারপরও কিছু করে না। শুধু পাইকারি ও খুচরা বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। এসব বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে কোনো লাভ হবে না। মিলগেটে নজরদারি বাড়াতে হবে।

বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের পলিসি গত ভুলের কারণে চালের দাম বাড়ছে। যেহেতু ১৫ দিন ধরে চালের দাম বাড়তি। এসময়ই সরকারের উচিত আমদানির ঋণপত্র (এলসি) ওপেন করে দেওয়া। কারণ আমদানির খবরে চালের দাম কমে এবং আমদানি বন্ধ হলে আবার বাড়ে। সরকার যদি আমদানি ওপেন না করে তাহলে চালের দাম আরও বাড়বে।  

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওএমএস চালু আছে সারাবছর। তবে এটা সীমিত ছিল। ৭৩০টি দোকানে চালু ছিল। এখন উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ১ হাজার ৭৬০টি ডিলারের মাধ্যমে আমাদের এএমএস চালু হচ্ছে। আমাদের চালের মজুদ এখন সর্বকালের সর্ব বৃহৎ মজুদ। এটা কোয়ালিটিফুল চালের মজুদ। আমি আশা করি মানুষ এটা নিয়ে খাবে। দেশে খাদ্যের কোনো অভাব নেই।

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় মানুষের এখন চিকন চাল খাবার প্রবণতা বেড়েছে। একজন রিকশাচালকও সরু চাল খেতে চায়। সরু চালের ওপর চাপ তো একটু পড়েছেই। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে নগদ দামে সরু চালটা তুলে নিয়ে প্যাকেট করে। প্যাকেটে বেশি দামে অনেকেই কেনেন।

খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরু চালের কিন্তু এখন অফ টাইম। সাধারণত বোরো মৌসুমে এটা উৎপাদন হয়, এখন ধান লাগাবে। আমরা এটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা ফাইলও পাঠিয়েছি, আরও কিছু ট্যাক্স কমিয়ে সরু চাল বেসরকারিভাবে আমদানি করা যায় কিনা। তবে এটাও ঠিক, আমরা সুষ্ঠু মনিটরিংয়ে আছি, আপনারাও যদি কোনো অবৈধ মজুদ সম্বন্ধে জানেন তাহলে আমাদের জানালে, আমরা সেখানে হানা দিতে পারি। তাহলে আমার বিশ্বাস চালের দাম নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে চালের দাম চার শতাংশ বেড়েছে। আর গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৮ শতাংশ। সর্বাধিক বেড়েছে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম।

শনিবার (২২ জানুয়ারি) রাজধানীর কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে জানা গেছে, বর্তমানে খুচরা বাজারে মিনিকেট প্রতিকেজি ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, নাজিরশাইল ৬৬ থেকে ৭০ টাকা, আঠাশ ও উনত্রিশ ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি, পাইজাম ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি সরু চাল (মিনিকেট) মানভেদে ৫৯ থেকে ৬২ টাকা। নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬৪ টাকা, বাসমতি ৬৮ থেকে ৭২ টাকা। মোটা চাল ২৮ নম্বর- মানভেদে ৪৩ থেকে ৪৭ টাকা, গুটি ৪০ থেকে ৪২ টাকা, পায়জাম ৪২ থেকে ৪৪ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এসব চাল দুই থেকে তিন টাকা কম দামে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া পাইকারি আড়তগুলোতে ১০ থেকে ১৫ দিন বিক্রি করার মতো চাল তাদের মজুদ রয়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, আমরা পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে চাল কিনে বেশি দামে বিক্রি করি। আড়তদারদের কাছে দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বলে, মিলগেটে দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে। এর প্রভাবে চালের দাম বাড়ছে।

গড়ে সরকারের গুদামে সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন বা দেশের মোট চাহিদার ১৫ দিনের চাল মজুদ থাকলে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৯ দশমিক ৭৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চাল রয়েছে ১৬  দশমিক শূন্য ৯ লাখ মেট্রিক টন। তবে ধানের পরিমাণ কম, মাত্র ৩৮ হাজার মেট্রিক টন। বাকিটা গম।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২২
জিসিজি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।