যাত্রীদের দুর্ভোগ আর হয়রানির ষোলকলা পূর্ণ হলো। যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া।
সিটিং-এ যেটুকু ‘সেবা’(?) ও স্বস্তি ছিল, সেটিও উধাও। যাত্রীদের সঙ্গে চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের অশোভন আচরণ, খিস্তিখেউড় চলছে সমানে। যাত্রীদের গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনারও খবর আসছে মিডিয়ায়। এমনকি গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেবার, ফেলে দেওয়ার মতো ভয়ানক ঘটনাও। আগে সিটিং সার্ভিসে নারীযাত্রীরা কষ্ট করে হলেও উঠতে পারতেন; কিন্তু হঠাৎ-লোকাল-সার্ভিসে সে-সুযোগটাও আর রইল না। ধাক্কাধাক্কির লড়াইয়ে অপারগ তারা। শিশু ও বৃদ্ধরা।
যেমনটা ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায়, রাস্তায়ও তেমনই পরিহাস। পায়ে যাতে আর ধুলা না লাগে সেজন্য রাজা হবুচন্দ্রের আদেশে সাড়ে ১৭ লক্ষ ঝাঁটা সঞ্চালনে ‘ধুলারে করিয়া দিতে দূর’ শুরু হয়েছিল এক অভিনব অভিযান! তাতে গোটা জগৎটাই হয়ে পড়লো ধুলায় ধুলাকার। :
‘ধুলারে করিয়া দিতে দূর
জগৎ করিল ধুলায় ভরপুর’
এভাবেই সিটিং সার্ভিস বন্ধের নামে মাথাচাড়া দিল এক ‘চিটিং সার্ভিস’। আর যাত্রীসাধারণ হয়ে পড়লো পরিবহন মালিকদের হাতের পুতুল। তাদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের সস্তা গিনিপিগ।
এখানেই শেষ নয়! অভিযান শুরুর পর ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাস বন্ধই করে দিলেন মালিকরা। ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাসহীন যখন রাস্তা, তখন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে পরীক্ষা। শিক্ষার্থীরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে। কিন্তু কোনো বাহন পাচ্ছে না। পরীক্ষার জন্য গাদাগাদি যানবাহনে যেতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে। ঠিক সময়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে যে পৌঁছতে পারবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
যে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী গালভরা আশ্বাস আর বুক ফোলানো বীরত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, তিন-চারদিনের মাথায় তিনিও চুপসে গেলেন। মঙ্গলবার তার মুখে শোনা গেল হতাশা: ‘কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী। ’
আইন, নীতি-সিদ্ধান্ত সবার বেলায় প্রযোজ্য নয় তাহলে! বিশেষ করে যদি কেউ হন প্রভাবশালী? যারা ‘সামান্য মানুষ নন, যারা খুব প্রভাবশালী’ তারা এসবের ঊর্ধ্বে। আইন ও সিদ্ধান্তের জাঁতাকল কেবল সাধারণ জনগণের জন্য? ক্ষমতাহীন ‘সামান্য’ মানুষদের জন্য? কেন এমন নির্মম প্রহসন!
নৈরাজ্য করবে অথচ প্রভাবশালী বলে পার পেয়ে যাবে! ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মানেই সাতখুন মাপ!গণতন্ত্রে তো এমনটা হবার কথা নয়!
‘খুব প্রভাবশালী’ বলে যাদের নাম আসছে তারা সরকারি দলের নেতা। এজন্যই কি সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগ? প্রভাবশালী মালিকদের মধ্যে আছেন পরিবহনশ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ঢাকাসহ সারাদেশের মালিক সমিতির নেতা পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের নেতা খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছেন জনগণের দুর্ভোগ ও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তিনি যে খুব একটা কিছু করতে পারবেন না, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন ‘তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী’ এই কাতরোক্তির মধ্য দিয়ে। তবে তিনি বলেছেন, ‘আজ বুধবার এ বিষয়ে পর্যালোচনা সভা হবে। ’
কিন্তু পর্যালোচনা সভাটি যেন ‘থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়’ না হয়। যেন ‘যথা পূর্ব্বং তথা পরং’ না হয়। যাত্রী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের আশঙ্কা, মালিকদের সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত মূলত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ারই অপকৌশল। কিছুদিন পর হইচই থেমে গেলে ভাড়া বাড়িয়ে কিছু পরিবহন কোম্পানি পুনরায় সিটিং সার্ভিসে চলা শুরু করবে। সরকার ও গণমাধ্যম কয়েক দিন হইচই করে থেমে যাবে। একপর্যায়ে যাত্রীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। বিআরটিএ-ও মালিকদের ফন্দিফিকিরের কাছে মাথা নত করবে। পর্যালোচনা সভায় তেমন কিছুর পথ যেন প্রশস্ত না হয়।
বিআরটিএ যেন মালিকদেরই সেই ফাঁদে পা না দেয়। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও বিআরটিএ-কে মনে রাখতে হবে ‘দুর্জনের ছলের অভাব হয় না’। মন্ত্রী যেন জনগণকে ভোগান্তিমুক্ত করাটা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করেন। মুষ্ঠিমেয় প্রভাবশালীর অন্যায় স্বার্থরক্ষা যেন না হয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, জনগণের জন্যই সরকার। আবার জনগণ্ই ক্ষমতার উৎস। সেই জনগণকে যেন কোনো মহল নোংরা প্রভাবের বৃদ্ধাঙ্গুলি না দেখায়। সরকার যেন জনগণকে একটুখানি স্বস্তি দেয়, যেন তাদের দুর্ভোগ লাঘবে আন্তরিক হয়। লোক দেখানো আস্ফালন আর ফাঁকা বুলি ঢের হয়েছে। এবার চাই সত্যিকারের জনবান্ধব, যাত্রীবান্ধব উদ্যোগ। যেন ভেস্তে যায় গুটিকয় প্রভাবশালীর ‘ছলনার পাশা খেলা’। যেন উল্টে যায় নোংরা দাবার ছক।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
জেএম