প্রশ্ন হতে পারে এটিতো আইসিটি অ্যাক্টের ধারা। তাতে কেবল অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো হুমকিতে।
আইনটি কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এর কারণ আইনটির অপপ্রয়োগের সমূহ আশঙ্কা। দেশের নাগরিক সমাজ বরাবরই এই আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করে আসছেন। তারা সরকারকে এমন একটি আইন পাস না করার আহবান অনেক আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের আহবানকে এখনো আমলে নেওয়া হয়নি।
আর সরকারের এই গা-ছাড়া ভাবটাকেই পূঁজি করতে শুরু করেছে কিছু কর্পোরেট হাউজসহ অনেকেই। আইনটি পাস হবার পর এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে এই আইনের আওতায় আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তুচ্ছাতি-তুচ্ছ কারণেও দেখছি ৫৭ ধারার প্রয়োগ।
পুলিশ যেনো মুখিয়েই আছে। সামান্য সুযোগেই সাংবাদিকের কোমরে দড়ি, হাতে হাতকড়া লাগাচ্ছে।
সমাজের, রাষ্ট্রের ব্যত্যয়গুলো তুলে ধরে সাংবাদিকরা আজ স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর কাছে এতটাই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে যে তাদের কোমরে দড়ি কিংবা হাতে হাতকড়া পরিয়ে কিংবা পরাতে দেখে বিমলানন্দ উপভোগ করছেন।
আর এতে ইদানিং ঢাল হিসেবে প্রায়শঃই ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন।
বিশেষ করে এই আইনের ৫৭ ধারার প্রয়োগের বিষয়টি সাংবাদিকদের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
ওই একটি ধারার কারণে আইনটির ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা দেবার এবং যে যার মতো এর ব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যায়। এই আইনের ৫৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে:
কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্যকর হইবে একটি অপরাধ৷’
কোনও ব্যক্তির ভাবমূর্তি কিংবা মানহানি রাষ্ট্রের সঙ্গে একাকার করে দেওয়া হয়েছে এই আইনে।
রাষ্ট্র অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তার জন্য এমন আইন অবশ্যই থাকতে হবে। যা মিথ্যা ও অশ্লীল তা প্রকাশ করা অবশ্যই যাবে না, মানুষকে নীতিভ্রষ্ট করে তুলতে কিংবা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধও করা যাবে না। আর সংবাদমাধ্যম তা করেও না।
কিন্তু ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কোনও অপরাধ করলে সে কথা কে বলবে? বলা হতে পারে সরকার দেখবে। আমরাও তাই বলি, সরকারকেই দেখতে হবে। কিন্তু সরকারের কাছে সেটা তুলে ধরবে সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমের আয়নায় ফুটে ওঠে সমাজের অসঙ্গতি। আর সে জন্যই সংবাদমাধ্যম সমাজের চতূর্থ স্তম্ভ।
ছিদ্রান্বেষীরা একটি আইনের ছিদ্র খুঁজে বের করে তার সুযোগ নিয়েই অপরাধ করে যায়। সংবাদমাধ্যম ওই তৎপরতাগুলোকেই সামনে আনে। অনেকের কাছে তুলে ধরলে তবেই ধরা পরে এদের কাণ্ড-কীর্তি।
এতে প্রাথমিকভাবে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আপাত মানহানি কিংবা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বটে, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের খবরের পর এমন অনেক অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, তার উদাহরণ লক্ষ, কোটি।
আরও একটু সরাসরি আলোকপাত করা যাক। সম্প্রতি দেশের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের করা আইসিটি-অ্যাক্টের মামলায় আটক হয়েছেন একজন সাংবাদিক। যাকে রিমান্ডের নামে অত্যাচারও করা হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা মোবাইল ফোন সেটসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক পণ্যের। তাদের দাবি দেশীয় পণ্য বিক্রি করে তারা দেশকে সমৃদ্ধ করছেন। সে দাবি তারা করতেই পারেন। কিন্তু তাদের পণ্য কতটা মানসম্পন্ন? টাকা দিয়ে কিনে ভোক্তা যথার্থ সেবা পাচ্ছে কি না? সেটা দেখার দায়িত্ব কার?
নিঃসন্দেহে সংবাদমাধ্যমের। দায়িত্ব এই জন্য যে, ভোক্তা যখন প্রতারিত হয় তখন সংবাদমাধ্যমের কাছেই যায়। এছাড়া তাদের আর যাওয়ার জায়গাটি কোথায়? তারা কিন্তু সমাজের চতূর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদপত্রের ওপর আস্থা রাখে। তখন যদি ওই প্রতিষ্ঠানের পণ্যের গুনগত মানের ওপর খোঁজ-খবর নিয়ে, ভোক্তাদের অভিযোগ সামনে এনে কোনও সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করে, তাতে ওই প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হবে বৈকি! তাদের ব্যবসা কমবে, মানহানি হবে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
তাতে কার কী যায় আসে? উপকারতো পেলো দেশের সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের পাশেই থাকবে সংবাদমাধ্যম।
কথায় কথায় আইসিটি অ্যাক্ট, আর তার ৫৭ ধারার জুজু দেখানো যাবে না। আর সরকার নিজেইতো এখন এই আইনের সংশোধনী চাইছে।
মঙ্গলবার (২ মে) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেছেন- ‘আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে না। ধারার যে ব্যাপারগুলো নিয়ে আপত্তি ও অস্পষ্টতা এবং যেখানে মনে হচ্ছে বাক স্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য এটি করা হয়েছে, সেগুলো পরিষ্কার করে দেবো। ’
এই পরিষ্কার করে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তবে তা দ্রুতই করতে হবে। কারণ এরই মধ্যে আইনটির দুর্বলতাকে পূঁজি করে স্বার্থান্বেষীরা তাদের স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে।
যেমনটা এখন করছে ইলেক্ট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি। যাদের পণ্যের মান নিয়ে অনেকেই অসন্তুষ্ট।
তবে কেবল যে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তা নয়, সরকারের কোনও বিভাগ, রাজনৈতিক কোনও মহলও তাদের নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে এই আইনের অপ্রয়োগ করতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতেও আমরা এর অপপ্রয়োগ দেখেছি সাংবাদিকদের ওপর।
আইনটির ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে এই আইনের ৫৭ ধারায় মামলা মানেই হচ্ছে বিবাদী জামিন অযোগ্য। আর অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল।
অপরাধ প্রমাণিত হলে জেল হবে সে নিয়ে কোনও কথা নেই। কিন্তু জামিন অযোগ্য মানেই হচ্ছে- যার বিরুদ্ধে মামলা হলো তার আর কিছুই করার নেই। তিনি আসলেই অপরাধী কি না? কিংবা যারা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা প্রকৃত অপরাধী কীনা সেটা নিশ্চিত করার আগেই অভিযুক্তের কারাবাস শুরু হয়ে যায়।
সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কঠোর আইন থাকতেই পারে। কিন্তু সে আইন এমন হতে হবে, যাতে তার সুযোগ নিয়ে কেউ যেনো সামান্য অপব্যবহারও করতে না পারে। নিশ্চিত করে বলা চলে- আইসিটি অ্যাক্ট তথা এর ৫৭ ধারা কোনওভাবেই তেমন একটি আইন হয়নি।
দেরিতে হলেও আইনমন্ত্রী ভুল ধরতে পেরেছেন। এবার প্রত্যাশা যত দ্রুত সম্ভব আইনটি সংশোধন হোক। সাংবাদমাধ্যম সমাজের চতূর্থ স্তম্ভ হিসেবে, ‘সমাজের চোখ’ হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাক।
তাতে সেবার নামে ফাঁদ পেতে সাধারণের গাঁট কেটে ফুলেফেঁপে ওঠা অপবাণিজ্য যেমন বন্ধ হবে, স্বার্থান্বেষীরাও তটস্থ থাকবে এই ভেবে যে তাদের অপকর্মের দিকে সংবাদমাধ্যমের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। আর তাতে উপকৃত হবে দেশের সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৭
এমএমকে