কক্সবাজার: দুই বছর আগে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল আবছার। তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির স্বাক্ষর জাল করার মাধ্যমে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল সে সময়।
দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোগ ওঠেছে, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর কক্ষের তালা ভেঙে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসে গেছেন তিনি। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যদিও পদে বসে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্রকে সামনে এনেছেন নুরুল আবছার। এ নিয়ে বিদ্যালয়টিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে শিক্ষক নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে আদালতে পৃথক দুটি মামলা হয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় এ দুই মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্রও জমা দেয়। মামলা দুটি বর্তমানে চকরিয়া জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে নুরুল আবছার দলবল নিয়ে এসে প্রধান শিক্ষকের পদে বসে যান।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা জানান, হুট করে নুরুল আবছার বিদ্যালয়ে এসে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ের তালা ভেঙে ঢুকে পড়েন। এ সময় তার সঙ্গে স্থানীয় বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছালেকুজ্জামানসহ কয়েকজন স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রভাবশালী উপস্থিত ছিলেন। ।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘৮ সেপ্টেম্বর নুরুল আবছার স্বদলবলে বিদ্যালয়ে এসে প্রথমে সব শ্রেণিকক্ষে তালা লাগিয়ে দেন। এ সময় আমি শিক্ষকদের কক্ষে ছিলাম। এরপর তিনি তালা ভেঙে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢোকেন। আমার কাছ থেকে জোর করেই দায়িত্ব বুঝে নেন। কমিটির মাধ্যমে নিয়ম মেনে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা বললেও তা তিনি শোনেননি। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ অক্টোবর সকালে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফখরুল ইসলামের কার্যালয়ে এ বিষয়ে একটি সভা ডাকা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। বরখাস্ত প্রধান শিক্ষকের পদে বসে যাওয়া ও সভা ডাকার এখতিয়ার নিয়ে ওইদিন বিদ্যালয়ের সভাপতি ও বরইতলী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ শাহীন মুরাদ আইনজীবীর মাধ্যমে ইউএনও বরাবর আইনি নোটিশ পাঠান।
১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বরইতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬০০। এমপিও ও নন-এমপিও মিলে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন ১৯ জন। ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে প্রাচীন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নুরুল আবছার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি ও সভাপতির স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই বছরের ১১ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো জবাব না মেলায় চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হয়।
মামলা ও বিদ্যালয়ের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে নুরুল আবছার শিক্ষার্থীদের বেতন, ভর্তি ফি, সরকারি উপবৃত্তির ভর্তুকি, টিউশন ফি, সরকারি অনুদানসহ বিভিন্নখাতে আয়ের অর্থ প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা না করে ও ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে এক কোটি ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৫৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিদ্যালয়ের চারটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির তদন্তে এই অনিয়ম ধরা পড়ে।
নিরীক্ষা কমিটির তদন্তে জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের সত্যতা পাওয়ায় বিধি মোতাবেক প্রধান শিক্ষককে শোকজ করা হয়েছে জানিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি মুহাম্মদ শাহীন মুরাদ বলেন, ‘শোকজের কোনো জবাব না পাওয়ায় কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় তাকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডকে অবহিত করা হয়। ’
২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চকরিয়া সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদী হয়ে প্রধান শিক্ষক নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে আত্মসাৎ করা অর্থ আদায়ের জন্যে মামলা করেন শাহীন মুরাদ। একই আদালতে তার স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে বরখাস্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেন মুরাদ। আদালত দুটি মামলা তদন্তের জন্যে সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
তদন্ত শেষে কক্সবাজার সিআইডির পরিদর্শক ও তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মো. মাহফুজুর রহমান গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আত্মসাৎ করা অর্থ আদায়ের মামলা এবং ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পরিদর্শক মো. মাসুকুল আলম স্বাক্ষর জাল করার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন।
সিআইডির পরিদর্শক মো. মাহফুজুর রহমানের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে উন্নয়ন কাজের নামে মেসার্স রাদিয়া এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মেমো ব্যবহার করে ভুয়া বিল বানিয়েছেন। যে মেমো নম্বরগুলো (মেমো নং-৫৪৮ থেকে ৫৫৪) ব্যবহার করা হয়েছে তা বিভিন্ন তারিখের হলেও পর পর সিরিয়ালের। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মৌলানা খলিলুর রহমান তদন্তে সিআইডিকে জানান, বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক মাঝেমধ্যে তার কাছ থেকে খালি ভাউচার নিয়ে যেতেন।
দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান শিক্ষক পদে বসা নুরুল আবছার বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারের একটি পরিপত্র আছে যে, ১৮০ দিনের মধ্যে (কোনো অভিযাগ সংক্রান্ত) বিভাগীয় কার্যক্রম নিষ্পত্তি করতে না পারলে এরপর ওই শিক্ষক কর্মচারী স্বপদে পুনর্বহাল হবেন এবং পূর্ণ বেতন ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্য হবেন। আমি এই পরিপত্র মূলে যোগদান করেছি। ’
পরিচালনা কমিটি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্বান্ত ছাড়া এমন পরিপত্রের ভিত্তিতে যোগদান বৈধ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ইউএনও, আমি তাকে অবহিত করেছি। তিনি মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন। ’
তালা ভেঙে পদে বসার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। আদালতে দুটি মামলা চলমান থাকার বিষয়ে নুরুল আবছার বলেন, ‘মামলা মামলার নিয়মে চলবে। ’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. ফখরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো মিটিং এখনো হয়নি। মিটিং করে আইন-কানুন পর্যালোচনা করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
ইউএনওর মৌখিক অনুমতি নিয়ে নুরুল আবছারের প্রধান শিক্ষকের পদে বসে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি আপনার যদি নীতিমালা কাভার করে এ রকম কোনো আদেশ থাকে, তাহলে আপনি বসবেন। ’
আপনি তো বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি, এ রকম কোনো আদেশ আছে কি না—প্রশ্ন করা হলে ইউএনও বলেন, ‘১৮০ দিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি না হলে স্বপদে বহাল হবেন, এ রকম একটি চিঠি আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছেন তিনি। ’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর রেজাউল করিম বলেন, ‘এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ২২০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০২৪
এসবি/এইচএ/