ঢাকা, বুধবার, ৫ চৈত্র ১৪৩১, ১৯ মার্চ ২০২৫, ১৮ রমজান ১৪৪৬

শিক্ষা

ঢাবির বহিষ্কৃতদের তালিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন, ৫ জন বহিরাগত

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
ঢাবির বহিষ্কৃতদের তালিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন, ৫ জন বহিরাগত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ১২৮ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ তালিকায় থাকা পাঁচজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী নন।

 

তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা হামলায় জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে হলভিত্তিক বিভিন্ন তালিকা করেছিলেন। তবে সত্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে অনেকের নামই আসেনি।

বহিষ্কৃতদের তালিকাটিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ উল্লেখ করে সত্যানুসন্ধান কমিটিসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছেন তারা। এ ছাড়া পুনরায় তদন্ত করে চিহ্নিত হামলাকারীদের শাস্তি দেওয়া উচিত বলেও মত দিচ্ছেন তারা।

এদিকে তালিকায় নিজেদের নাম নাম থাকা-না থাকা নিয়ে বিদ্রূপ করছেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রশাসনকে গালমন্দ করতেও দেখা যায় তাদের।

১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরুরি সভায় ১২৮ জন হামলাকারীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সিন্ডিকেট। তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর সেখানে অনেক চিহ্নিত হামলাকারীর নামই দেখা যায়নি।

তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৭৭ নম্বরে রিজভী আহমেদ খোকা, ৮০ নম্বরে রুবেল খান, ৮২ নম্বরে ইব্রাহীম হোসাইন সানিম, ১২১ নম্বরে মাহমুদুল হাসান আকাশ ও ১২৬ নম্বরে মো. আক্তার হোসেন রুমনের নাম রয়েছে।

তারা কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। তবুও তাদের সাময়িক বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এর মধ্যে রিজভীকে বহিরাগত, রুবেলকে কুয়াকাটা ছাত্রলীগের পদপ্রার্থী ও শেখ ইনানের অনুসারী, সানিমকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি, আকাশকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ইউনিটের সভাপতি এবং রুমনকে সরকারি বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তালিকায় ১১৯ নম্বর ঘরটি ফাঁকা রয়েছে। সেখানে কোনো হামলাকারীর তথ্যই নেই।

হামলার নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের নাম থাকলেও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের নাম তালিকায় নেই।  

শিক্ষার্থীরা বলছেন, তানভীর হাসান সৈকতের নাম বাদ পড়া আশ্চর্যজনক। সৈকত হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন বলেও দাবি করেন তারা।

তালিকায় থাকা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের নাম রয়েছে। তাদের সনদ বাতিল বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কি না, তা তদন্ত কমিটি সুপারিশ করবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

১৫ জুলাই ও ১৭ জুলাই শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে হামলা চালান ছাত্রলীগের বিজয় একাত্তর হলের সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনূস। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদকে আঘাত করে মারাত্মক আহত করেন। এ ছাড়া একাধিক শিক্ষার্থীকে শাহবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মারধরও করেন তিনি। অথচ তার নাম তালিকায় নেই।

এ ছাড়া ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আকিব মাহমুদ ফুয়াদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের কামাল উদ্দিন রানা, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আল-আমিন রহমানসহ অনেক হামলাকারীর তথ্য তালিকায় আসেনি।

সত্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে আসা সবচেয়ে বেশি হামলাকারী বিজয় একাত্তর হলের। এ ছাড়া কবি জসীম উদ্দীন হল ও মাস্টার দা সূর্যসেন হলেরও উল্লেখযোগ্য হামলাকারী রয়েছে।  

বিজ্ঞান অনুষদের তিনটি হল থেকে মাত্র তিনজনের নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অমর একুশে হল থেকে কোনো হামলাকারীর নাম নেই। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল থেকে একজন ও জগন্নাথ হল থেকে মাত্র দুজনের নাম পাওয়া গেছে। ছাত্রীদের হল থেকে কোনো হামলাকারীর নাম তালিকায় উল্লেখ নেই।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব হলের একাধিক হামলাকারী থাকলেও প্রতিবেদনে তাদের নাম আসেনি। ক্ষুব্ধ হয়ে ১৮ মার্চ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে যায় একদল শিক্ষার্থী। সেখানে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি চায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক আলী বাংলানিউজকে বলেন, হামলার যেসব স্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলেও চিহ্নিত হামলাকারীর সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রমাণ নিয়ে তালিকাও করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। আওয়ামী লীগের হামলা-মামলায় জড়িত না থাকার যে বয়ান, এই তালিকা সেটিকে শক্তিশালী করছে।

তিনি বলেন, এখানে অসঙ্গতি, অনৈতিকতাসহ অন্য কোনো বিষয় রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে। আমরা আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ভুল স্বীকার করে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেবে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকৃত তালিকা দেবে।  

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সত্যানুসন্ধান কমিটির এই তালিকা কোনো চূড়ান্ত তালিকা নয়, বরং অধিকতর তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলামকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এই কমিটি সত্যানুসন্ধান কমিটির চিহ্নিত করা ১২৮ জনের বিষয়টি আমলে নিয়ে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সহিংস ঘটনায় জড়িতদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেবে।

প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে খুব শিগগিরই তদন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করবে। পূর্ণাঙ্গ তালিকার ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বহিরাগত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় স্ব স্ব প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করবে ঢাবি প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, তালিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুজনের নাম রয়েছে, তাদের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। পটুয়াখালীর যে ছাত্রলীগ কর্মীর নাম রয়েছে, তার বিরুদ্ধে সেখানকার প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।

তালিকা নিয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ

এদিকে বহিষ্কৃতদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে ছাত্রলীগের একাধিক নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন। ছাত্রলীগের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ আহমেদ সরাসরি লাঠিসহ হামলায় অংশ নিলেও তালিকায় তার নাম আসেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহর নাম উল্লেখ করে লেখেন, ‘আমার নাম কই?’

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ রাহুল ফেসবুকে লেখেন, ‘যে তালিকায় আমার নাম নেই, তা ইনক্লুসিভ হয়নি। তাছাড়া এটি কর্তৃত্ববাদী তালিকা, এখানে হলপাড়ার ছেলেদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ’

তালিকা প্রকাশের পর রাহুল ছয়জনের ছবিসহ একটি ফেসবুক পোস্ট করেন। ছবিতে রয়েছেন ছাত্রলীগের কর্মী রামীম, মেহেদী হাসান, ইশতিয়াক ফারদীন, ও কৌশিক হাসান পরশ। তারা প্রত্যেকেই হামলায় অভিযুক্ত হয়ে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন।

সীমাবদ্ধতার দোহাই দিচ্ছে সত্যানুসন্ধান কমিটি

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক কাজী একরামুল হককে প্রধান করে ২৯ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।  

পরে ৮ অক্টোবর কমিটিতে আইন অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপণকে প্রধান করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বাড়িয়ে ৪৫ দিন করা হয়।

তবে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সত্যানুসন্ধান কমিটি গত ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, তদন্ত কমিটির কাজে গাফিলতি রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের হামলার স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সে তালিকার অনেক নাম সত্যানুসন্ধান কমিটিতে নেই।

তবে সত্যানুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক কাজী মাহফুজুল হক প্রতিবেদন তৈরিতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমরা পুলিশ নই। আমাদের সেই জ্ঞান নেই। তা ছাড়া আমরা একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছি।

তিনি জানান, তথ্যানুসন্ধান কমিটির মধ্যে দুজন হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া বাকিদের প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তারা কেবল শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য, নথি, ছবি-ভিডিও এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ফুটেজ ব্যবহার করেছেন বলে জানান।

প্রতিবেদন তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা সিসিটিভি কোনো কাজে আসেনি বলেও জানান সহযোগী অধ্যাপক সুপণ। তিনি বলেন, হলের সিসিটিভির হার্ডড্রাইভ আমরা পাইনি। এ ছাড়া উপাচার্যের বাসভবনের সিসিটিভির ফুটেজও আমরা পাইনি। অনেকগুলো সিসি ক্যামেরা এমনভাবে লাগানো, গাছের পাতা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এই প্রতিবেদনে আরও অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে বলেও মত দেন সহযোগী অধ্যাপক সুপণ।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
এফএইচ/আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।