ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ক্লাস না নিলেও বেতন পান ঠিকই!

মাসুক হৃদয়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৪
ক্লাস না নিলেও বেতন পান ঠিকই! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ব্রাহ্মণবাড়িয়া (সরাইলের হাওরাঞ্চল থেকে ফিরে): ঝুমা ও মরিয়ম দু’জনেই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। পাঁচ বছর ধরে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করলেও তারা কখনো আরমিনা এবং মার্জিয়া ম্যাডামকে দেখেনি।

শুধু ঝুমা ও মরিয়ম নয়, ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের বক্তব্য- তারা কখনো আরমিনা ও মার্জিয়া ম্যাডামের নাম পর্যন্ত শুনেনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার হাওর বেষ্টিত পাকশিমুল ইউনিয়নের তেলিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাগজে-কলমে নাম রয়েছে দুই বোন আরমিনা ও মার্জিয়ার।

উপজেলা সদরের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মনির উদ্দিন আহমেদের মেয়ে আরমিনা ও মার্জিয়া। তারা নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে কখনোই ওই বিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে আসেননি। তাদের বদলে দুই হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে ‘প্রক্সি’ ক্লাস চালাচ্ছেন তেলিকান্দি গ্রামের গৃহবধূ অষ্টম শ্রেণী পাস হেলেনা বেগম এবং পার্শ্ববর্তী নাসিরনগর উপজেলার কচুয়া গ্রামের দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া কাজী ফখরুল মোবারক ওরফে নওয়াব মিয়া।

সম্প্রতি সরেজমিনে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২০১০ সালে আরমিনা আক্তার ও ২০১৩ সালে মার্জিয়া আক্তার নিয়োগ পান। কিন্তু তারা স্কুলে না এসে নিয়মিত কলেজে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বিদ্যালয়টিতে পাঠদান বিঘ্ন হচ্ছে।

অবশ্য পাঠদান বিঘ্ন হবার কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কোহিনূর বেগম। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারেই এই দুই শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন।

স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী শিক্ষক আরমিনা আক্তারের বদলে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন অষ্টম শ্রেণি পাস হেলেনা বেগম।

তিনি (হেলেনা) অকপটে স্বীকার করে বলেন, ‘চার বছর ধরে এভাবে ক্লাস নিচ্ছি। বিনিময়ে প্রতিমাসে আরমিনা ম্যাডাম আমাকে দুই হাজার টাকা করে দিচ্ছেন। ’

বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ চলতে থাকায় অপর একটি কক্ষে একই সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন ‘প্রক্সি’ শিক্ষক কাজী ফখরুল মোবারক ওরফে নওয়াব মিয়া।

তিনি জানান, তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী নাসিরনগর উপজেলার কচুয়া গ্রামে। তিনি প্রায় ১০/১২ বছর আগে থেকেই তেলিকান্দি গ্রামে থেকে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে আসছেন। প্রায় দেড় বছর ধরে এই স্কুলে মার্জিয়া আক্তারের বদলে ক্লাস নিচ্ছেন। বিনিময়ে মাসে দুই হাজার টাকা করে পাচ্ছেন তিনি।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কোহিনূর বেগম জানান, ৬ সেপ্টেম্বর ওই দুই শিক্ষক বিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং ওই দিনই বিগত অনুপস্থিত থাকা দিনের ঘরে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন।

বিদ্যালয় সংলগ্ন চকবাজারের জনৈক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দু’বোন এভাবেই চাকরি করে আসছেন। উপজেলা সদরের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান হওয়ায় এ অনিয়মের প্রতিবাদ করার সাহস স্থানীয় কারো নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয়টিতে মোট চারজন নারী শিক্ষক কর্মরত। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক লাভলি আক্তার প্রশিক্ষণে রয়েছেন। দু’বোন আরমিনা ও মার্জিয়ার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ‘প্রক্সি’ দুই শিক্ষককে নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে ক্লাস চালাচ্ছেন।
 
‘প্রক্সি’ শিক্ষক বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কোহিনূর বেগম প্রথমে ওই দুই বদলি শিক্ষককে প্যারা শিক্ষক হিসেবে দাবি করেন। প্রশ্নের মুখে পরে তিনি তাদের প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অবগত আছেন। তিনি এ ব্যাপারে তার অসহায়ত্বের কথাও অকপটে স্বীকার করেন।

বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি জেলা শহরে বসবাসরত হেলাল উদ্দিন জানান, দুর্গম এলাকা হওয়ায় উপজেলা সদর থেকে নিয়মিত আসা কষ্টসাধ্য।
 
সরাইল উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল জানান, এ বিষয়টি তার জানা নেই। সাম্প্রতিককালে তিনি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেননি। তবে, শেষ বার যখন গিয়েছিলেন তখন ওই দুই শিক্ষক বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল খায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি গত ২১ আগস্ট এখানে যোগ দিয়েছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
 
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত বণিক বলেন, প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে কেউ ক্লাস চালালে ওই শিক্ষক সাসপেন্ড হবে। তদন্তক্রমে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে মার্জিয়া আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি ঘটনা অস্বীকার করেন। পরে বিষয়টি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করলে তিনি বলেন, কলেজে আসা যাওয়ার কারণে ২/৩ দিন ক্লাসে যেতে পারি না। তখন ফোনে ছুটি নিয়ে নিই।

পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘প্রক্সি’ শিক্ষকের বিষয়টি অস্বীকরা করে বলেন, আমরা কোনো পারিশ্রমিক দেই না, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্তে তারা নিজেরাই ক্লাস নেয়।

এছাড়াও উপজেলা সদরে হাজিরা খাতায় সই করা ও আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ে হিসেবে প্রভাব খাটানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন মার্জিয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।