নীলফামারী: নীলফামারী জেলার ৩১৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রধান শিক্ষক। ফলে এ বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত পড়ালেখা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি স্কুল পরিচালনার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে এসব পদ পূরণ না হওয়ায় কিছু বিদ্যালয়ে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা, কিছু বিদ্যালয়ে বিদ্যমান চরম অব্যবস্থাপনা। অনেক বিদ্যালয়েই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে মানতে চান না সহকারী শিক্ষকেরা।
তবে পদোন্নতি এবং নতুন নিয়োগের ব্যবস্থা না হওয়ায় এসব পদ পূরণ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, পুরোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সদ্য সরকারি হওয়া বিদ্যালয়গুলো নিয়ে জেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৪৭টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজার ৩৪৯ জন। এ ৯৪৭টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক পদে অনুমোদিত বিদ্যালয় রয়েছে ৮৮১টি। এসব অনুমোদিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদের বিপরীতে দায়িত্বরত রয়েছেন ৫৬৮ জন। ফলে ৩১৩টি স্কুলের কাজ চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়াই।
প্রধান শিক্ষকহীন বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ৩১টি, জলঢাকায় ৯২টি, ডিমলায় ৫৫টি, ডোমারে ৬০টি, নীলফামারী সদরে ৬২টি এবং সৈয়দপুর উপজেলায় রয়েছে ১৩টি বিদ্যালয়।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ উপজেলার ছিট রাজীব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩শ।
প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকের পদ রয়েছে ৬টি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য থাকায় এ বিদ্যালয়ে অনেকটা অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
বর্তমানে বিদ্যালয়টির দায়িত্বে রয়েছেন সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম। কিন্তু সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে ২ জনের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের শেষ নেই। এমনকি তাদের ওপর তার কর্তৃত্বও নেই।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, সহকারী শিক্ষক আবু হেলাল ও নাহিদ হোসেন যথাসময়ে বিদ্যালয়ে আসেন না, ঠিকমতো ক্লাস নেন না। বাধ্য হয়ে তিনি ওই ২ জনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
তবে এ অভিযোগ নিয়েও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষকদের।
অভিভাবক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য জামুদ্দি মামুদ ও দুলাল হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কেউ কারো কথা শোনেন না। এতে পড়াশোনার মানোন্নয়ন হচ্ছে না, স্কুল পরিচালনায় ত্রুটি দেখা দিচ্ছে।
দায়িত্বরত প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম আরো জানান, মাসে সরকারি কাজে অন্তত ৩/৪দিন যেতে হয় উপজেলায়। এছাড়া নানা কাজে অংশগ্রহণসহ অন্যান্য কাজও রয়েছে। এতে স্কুলের পড়াশোনা ব্যাহত হয়।
একই কথা বললেন নীলফামারী সদর উপজেলার বিশমুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষক আল হোসাইন আদল। তিনি জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫শ জন। এদের বিপরীতে ৮ জন শিক্ষকের স্থলে দায়িত্বরত রয়েছেন ৬ জন।
প্রধান শিক্ষক না থাকায় ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে পাঠদান করার পাশাপাশি অতিরিক্ত হিসেবে অন্যান্য কাজ করতে হচ্ছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এছাড়া বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্যত্র দায়িত্ব পালন করায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে বলেও অভিযোগ তার।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার ছিটরাজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ইয়ামিন কবির স্বপন অভিযোগ করেন, গত ৫ বছর ধরে বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষক নেই। এতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সহকারী একজন শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকায় অন্যান্য শিক্ষকরা তাকে মানতে চান না। অনেক সময় তার নির্দেশ পালনেও অনীহা দেখান সহকারী শিক্ষকরা।
সূত্র জানিয়েছে, প্রধান শিক্ষকহীন এসব বিদ্যালয়ের এমন চিত্র অন্তত ১ বছর থেকে ৫ বছরের বেশি সময়ের। সর্বশেষ ২০১২ সালে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে ২৭ জনকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করা হয়। এরপর থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়াও থমকে আছে।
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, বিদ্যালয়গুলোতে পদোন্নতির মাধ্যমে ৬৫ ভাগ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৩৫ ভাগ পদ পূরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু পদোন্নতি জটিলতা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা না হওয়ায় পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে শুন্য রয়েছে।
নীলফামারী সদর উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার রহুল আমিন প্রধান শিক্ষকহীন বিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান সমস্যার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, আমার তত্ত্বাবধানে ২৪টি বিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে ৮টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই দীর্ঘদিন। দায়িত্বে রয়েছেন সহকারী শিক্ষকরা। অনেক ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের আদেশ-নির্দেশ মানতে চান না অন্যান্য শিক্ষকরা। সেক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়।
তবে এজন্য প্রশাসনিক কাজে কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি। শিগগিরই প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানোর কথাও জানান তিনি।
যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিলীপ কুমার বণিক প্রধান শিক্ষক না থাকায় স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় প্রভাব পড়ছে মন্তব্য করে বলেন, আমরা শুন্য পদ পূরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে লিখিতভাবে জানিয়ে আসছি।
কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এসব পদ পূরণ করা সম্ভব নয়।
তবে শিগগিরই শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৫
এসআর/