ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

বাংলানিউজের অনুসন্ধান

এবার শিক্ষকদের ঘুষ দেওয়ার মিশনে সাইফুরস!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৬
এবার শিক্ষকদের ঘুষ দেওয়ার মিশনে সাইফুরস!

ঢাকা: হ্যাকিং করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের শোরগোলের মাঝেই দক্ষ ‘হ্যাকার তৈরির বিজ্ঞাপন’  দেওয়া সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

‘চোর বানানোর বিজ্ঞাপন’ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি ফাঁদ পেতে  সংগ্রহ করেছে শিক্ষার্থী।

কমিশনের টোপ ফেলে কলেজ শিক্ষকদেরকেও জড়িয়েছে ঘুষ বাণিজ্যে।

কলেজ শিক্ষক ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বী কোচিং সেন্টারের পরিচালকদের কমিশনের নামে এ ঘুষ বাণিজ্যের  ফাঁদে ফেলতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামার প্রমাণ মিলেছে বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ডে।

‘ধর্মীয় পোশাকের লেবাসে এভাবে পদে পদে অনৈতিকতা আর অনিয়মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান খান অর্থপিপাসু হয়ে উঠেছেন। এটা তার স্রেফ ভণ্ডামি’ এমনটিই বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা।

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দু’বছরের শিক্ষাকতা করার সুবাদে নামের শেষে ‘স্যার’ বনে যাওয়া সাইফুর রহমান খানের সাইফুরস কোচিং সেন্টার মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে’- এমন দাবি করে এর আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কোচিং সেন্টারটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।

কলেজ শিক্ষকদের ঘুষ দেওয়ার মিশনে নেমে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ঘাটে ঘাটে অর্থ ঢেলে পার পাওয়ার চেষ্টায় থাকা ‘হ্যাকার তৈরির প্রতিষ্ঠানটি’।

বাংলানিউজের গভীর অনুসন্ধানে খোদ প্রতিষ্ঠানটির এক সার্কুলারের সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে এ চিত্র।
 
‘হ্যাকার তৈরির বিজ্ঞাপন’  দেওয়ার ডামাডোলেই ‘সকল শাখার জন্যে জরুরি নোটিশ’ শিরোনামে গত ০৪ মে এইচআরডি:২২২/৫/২০১৬ স্মারকে শাখার কর্মীদের বলা হয়, ‘কোচিং সেন্টারের পরিচালক ছাড়াও জনপ্রিয় শিক্ষকদের কমিশনের অফার দিতে হবে। আশেপাশের কোচিং সেন্টারের প্রতি নজর রেখে তাদের পরিচালকদের হাত করতে হবে’।

এ ছাড়াও প্রাইভেট পড়িয়ে জনপ্রিয় কলেজের এমন শিক্ষকদের শাখায় এনে তাদের সঙ্গে সভা করার নির্দেশনাও দেওয়া হয় ওই নোটিশে।

নির্দেশনায় বলা হয়, ‘একটি জরুরি বিষয়: কোচিং বন্ধ করে দেয়া হবে। সরকারের এই নির্দেশের কারণে যারা প্রাইভেট পড়ান, এমন অনেক শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না’। তাদের শিক্ষার্থীদের সাইফুরস কোচিং সেন্টারে পাঠাতে উদ্ধুব্ধ করার বিনিময়ে প্রাপ্ত ফি’র ৫০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই নোটিশে।

এ কৌশলে পুরান ঢাকার শাখা প্রধান খাজা আহমেদ সফল হয়েছেন উল্লেখ করে তাকেও অভিনন্দন জানানো হয়।

পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ১০/১২টি একাডেমিক কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্য পূরণে একাডেমিক কোচিং ও প্রাইভেট পড়ান এমন শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়।

‘সেসব তথ্য রিপোর্ট আকারে শাকিল ও ভার্সিটি কোচিং কো-অর্ডিনেটর আনিসের ই-মেইলে পাঠাতে হবে’। অন্যথায় বেতন থেকে জরিমানা বাবদ ৫ ভাগ অর্থ কেটে রাখা হবে বলেও হুশিয়ারি দেওয়া হয়।

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে সাইফুরস সেরা কোচিং। আর ভর্তি হলে  চান্স নিশ্চিত করতে আমরাও বদ্ধপরিকর’ এমন নিশ্চয়তা দিয়ে দ্রুত সকলকে উদ্ধুব্ধ করতে শিক্ষক ও কোচিং পরিচালকদের সঙ্গে চুক্তি করারও নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই নোটিশে।

অন্যান্য কোচিং সেন্টার শিক্ষকদের কি পরিমাণ কমিশন দিচ্ছে, তা অনুসন্ধান করে শিক্ষার্থী টানতে অতিরিক্ত কমিশন প্রদানের পাশাপাশি অনৈতিক ও অনিয়মের আশ্রয় নিতেও বলা হয় শাখা প্রধানদের।

‘অগ্রিম প্রদান’ শিরোনামে ওই অফিস আদেশে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়,‘ধরুন,পুরনো ঢাকার শাখার  বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ফি ৭ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে আড়াই হাজার টাকা বাড়তি ধরে কলেজ শিক্ষক বা কোচিং পরিচালকদের উদ্ধুব্ধ করতে হবে। তাদের বলতে হবে, আপনাদের সুপারিশ ও রেফারেন্স যেসব শিক্ষার্থী আসবে তাদের ৫শ’ টাকা ছাড় দেওয়া হবে। আর অবশিষ্ট ২ হাজার টাকা আপনাদের কমিশন’। এভাবে কই এর তেলে কই ভাজার মতো অনৈতিকতার আশ্রয়ের ফলাফল হিসেবে বলা হয়, ‘এতে সর্বনিন্ম কোচিং ফি ঠিক থাকলো, আবার বাড়তি টাকা থেকেই শিক্ষকদের কমিশন দেওয়া গেলো’।

ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সাইফুরস কোচিং সেন্টারের ফাঁদে ফেলতে প্রথমে সংখ্যা ভিত্তিতে পুরো অর্থের টোপ ফেলে শিক্ষকের অবস্থা বুঝে অগ্রিম কমিশন হিসেবে ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই নোটিশে।

নোটিশের নিচে স্বাক্ষর করেন সাইফুরস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারপার্সন শামসা আর খান ডলি, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আনজাম আনসার, হেড অব অপারেশন ও বর্তমান চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মাহমুদুল আলম এবং ভার্সিটি ভর্তি কো-অর্ডিনেটর আনিছুল ইসলাম আনিস।

এ নোটিশের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটা সাইফুরস কোচিং সেন্টারের স্রেফ অনৈতিকতা আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান খানের ভণ্ডামি’।
 
‘দেখেন, তার পোশাক-আশাক। ধর্মীয় লেবাসে জোব্বা পরে তিনি ক্লাস নেন। আর অন্তরালে এভাবে কমিশন দেন, তা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’।

‘এভাবে কমিশন নামের ঘুষ দিয়ে সাইফুরস কোচিং শিক্ষকদের বিভ্রান্ত ও বিপথে নিচ্ছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

‘এদের মতো ভণ্ড ও মানুষবেশি অমানুষরাই শিক্ষকদের দুর্নীতির পথে আনছে। আবার ধর্মের লেবাস পরে মানুষকে বিভ্রান্তও করছে। তাদের অনিয়মে জড়াচ্ছে’- যোগ করেন মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষ কর্মকর্তা।

বার বার যোগাযোগ করা হলেও  সাইফুরস কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান খান ফোন না ধরে কেটে দেন।

সাইফুরস প্রাইভেট লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মাহমুদুল আলম শিক্ষকদের ঘুষের ফাঁদে ফেলতে দেওয়া নোটিশটির বিষয়ে স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এসবই ব্যবসায়িক কৌশল। নৈতিকতা কিংবা অনৈতিকতা জানি না’। সকল সিদ্ধান্ত সাইফুর রহমান খান স্যারের বলেও জানান তিনি।

চলতি বছরের ভার্সিটি অ্যাডমিশন প্রোগ্রামের প্রসপেক্টাসে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, নবমসহ ২ হাজার ৩শ’ ৭৭ জনের অবিস্মরণীয় সাফল্যের কথা তুলে ধরে। এ ছাড়াও ওই প্রসপেক্টাসে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমন্ত্রিত অতিথি করে তাদের বক্তব্য দেওয়ার কথা তুলে ধরা হয়।
 
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে সাইফুরস সেরা কোচিং। আর ভর্তি হলে  চান্স নিশ্চিত করতে আমরাও বদ্ধপরিকর’ এমন নিশ্চয়তা দেওয়া নোটিশের ভাষা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটা সাইফুর রহমান খানের প্রতারণা। তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। সেটা ভাঙ্গিয়েই চলছে তার কোচিং বাণিজ্য’।

‘তিনি কি প্রশ্ন যারা করেন তাদের সঙ্গে যুক্ত? না হলে কি করে শিক্ষার্থীদের ভর্তির নিশ্চয়তা দেন তিনি? এর উপযুক্ত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন’ বলেও মত দেন ওই সিনিয়র শিক্ষক।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, কোচিং সেন্টারটির পক্ষ থেকে ছেলে-মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়েছে- ‘ভালো ইংরেজি শিখলে ভালো চোর হতে পারবা, ভালো করে হ্যাকিং করতে পারবা’। চুরি শেখানোর বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে- ‘ভালো চোর বানাবে’। এখন শিক্ষকদের দুর্নীতি আর অনিয়মের পথে ঠেলে দিচ্ছে তারা।

‘সাইফুরস কোচিং সেন্টারের বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান। আইনগত ব্যবস্থার প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়’। এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন থেকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান শিক্ষামন্ত্রী।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৬
জেডআর/ এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।