ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ছুটিহীন ৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন বুধবার

উপজেলা করসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৯ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৭
ছুটিহীন ৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন বুধবার শিক্ষক বাহাজ উদ্দিন ফকির (৬০)

মধুপুর (টাঙ্গাইল): শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। সব সময় যিনি শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বোপরি দেশ নিয়ে ভাবেন এবং দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন তিনিই তো প্রকৃত শিক্ষক। 

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাহাজ উদ্দিন ফকির (৬০) এমনই একজন শিক্ষক। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন তিনি।

বুধবার (৩১ মে) তার শেষ কর্ম দিবস। ৩৮ বছরে ৭৬০ দিন প্রাপ্য ছুটি ভোগ করেননি তিনি।  

কীভাবে সম্ভব ছুটিহীন ৩৮ বছরের চাকরি জীবন কাটানো? 

বাহাজ উদ্দিন ফকির জানান, শুক্রবার এবং নির্দিষ্ট ছুটি বাদে প্রতিদিনই তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকেছেন। দায়িত্ব পালনকালে বাবার মৃত্যু, নিজের বিয়ে, স্ত্রীর অসুস্থতা, প্রথম সন্তানের জন্ম, পারিবারিক কোনো সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এজন্য তিনি বিদ্যালয় থেকে সম্মান ও পুরষ্কার পেয়েছেন। তাকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে অসংখ্য প্রতিবেদন। অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি অভিনন্দিত এবং সম্মানিত হয়েছেন। তার এ অনন্য দৃষ্টান্তে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তার বিদ্যালয়ে অনেকে ছুটে এসে বিদ্যালয়ের নানা কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। এসব নিয়ে তিনি গর্বিত।

স্মৃতির রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৫৭ সালের ১ জুন মধুপুর উপজেলার গোপদ গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম। টানাটানির সংসার বলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ যোগাড় করতে শুরু করেন। খুব কষ্টে ১৯৭৩ সালে মধুপুর রাণী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৭৫ সালে মধুপুর কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৭৭ সালে ধনবাড়ী ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৭৯ সালের বাইশতম জন্ম দিন অর্থাৎ ১ জুন তিনি তৎকালীন শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৮ সালে বিএড করে পরে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে সিপিডি-ওয়ান ও সিপিডি- টু প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৯০ সালের কথা। ঈদের ছুটিতে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার গুণারীতলা গ্রামের মৃত কাদের চেয়ারম্যানের মেয়ে শামসুন্নাহারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতায় বিদ্যালয় চালু হওয়ার পরদিন শ্বশুর বাড়িতে অনুষ্ঠান। বিদ্যালয়ের চারটি ক্লাস নেয়ার পর ছুটি নিয়ে চললেন শ্বশুরবাড়ী। রাত ১২টায় পৌঁছে ভোরে আবার ফিরতি পথে যাত্রা। বেলা ১১টায় এসে ক্লাস ধরেন তিনি। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসের কোনো এক শুক্রবার। স্ত্রী শামসুন্নাহার সন্তান সম্ভবা। তাকে নিয়ে পরদিন কাক ডাকা ভোরে মধুপুর ফেরার কথা বাহাজ ফকিরের। উদ্দেশ্য- ক্লাস ধরবেন। শুনলেন- কোনো কারণে যানবাহন বন্ধ। শ্বশুরালয় থেকে একটি বাই সাইকেল নিয়ে স্ত্রীকে পেছনে বসিয়ে ছুটলেন গন্তব্যের উদ্দেশে। ছুটছেন আর ঘড়ি দেখছেন। ১১টায় ক্লাস, তাই সঠিক সময়ে পৌঁছানোর জন্য সকাল ১০টায় তিনি তার সাইকেলের গতি বাড়ালেন। শেষে স্ত্রীকে রিকশায় তুলে বাড়ির পথে দিয়ে ১১টার বাজার কয়েক মিনিট আগে ক্লাসে পৌঁছান তিনি। কর্মদিবসে প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল শ্বশুরালয়ে। তাই শুক্রবারের অপেক্ষায় থেকে সন্তানের মুখ দেখতে হয়েছে তাকে। বাবা আব্দুল হামিদ ফকির ২০০৩ সালের ২৭ জুন শুক্রবার মারা যান। এর পরদিনই কাজে যোগ দেন কর্মপরায়ন বাহাজ উদ্দিন ফকির। এমনই নানা স্মৃতি আজ তাকে নাড়া দিচ্ছে।
 
বাহাজ উদ্দিন জানান, শিক্ষকতা শুরুর বছর বিদ্যালয়ের অপর দুই শিক্ষক শেখ আব্দুল জলিল ও আব্দুর রশিদ সারা বছরে একদিনও ছুটি না ভোগ করায় পুরষ্কৃত ও সম্মানিত হন। সেই ঘটনাই তাকে মূলত উদ্বুদ্ধ করে। তার তিন সন্তানও অনুপস্থিত না থাকার প্রতিযোগিতা করে করে এগিয়ে গেছেন। সহকর্মী ও কর্মচারীরা তাকে অনুসরণ করে পুরষ্কার পেয়েছেন।  

তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে অনেকে ছুটে এসেছেন তার বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শাখা চালু হওয়া) শহীদ স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিকে। দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে তাকে অভিনন্দিত করেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিক্ষানুরাগী কুতুবউদ্দিন শিক্ষার্থীদের জন্য খেলনা ও চকলেট নিয়ে এসে বাহাজ ফকিরের সঙ্গে দেখা করেছেন। পরে তিনি তাদের বিদ্যালয় সংস্কার করে দেন। বাহাজ ফকিরের সম্মানে শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীকে স্কুল ব্যাগ ও টিফিন বক্স উপহার দেন তিনি। তার মাধ্যমে ওই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দু’টি কম্পিউটার ল্যাবরেটরি নির্মাণসহ আসবাব উপহার দেন দেলোয়ার হোসেন শাবান নামে এক কানাডা প্রবাসী ও শর্মিলা আহমেদ নামে এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। এভাবে বাহাজ উদ্দিনের সম্মানে কুতুবউদ্দিন ২৫ লাখ টাকার কাজ করে দিয়েছেন। এভাবে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্মান পেয়েছে ধন্য বাহাজ উদ্দিন।  

৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনে শেষ দিন অতিবাহিত করছেন বুধবার। বাহাজ ফকির বললেন, দেশকে এগিয়ে নিতে ওই ছুটির দিনগুলোর ব্যবহার করা দরকার মনে করেছি। মনে করতে চাই না যে আজ আমার শেষ কর্ম দিবস। শেষ পর্যন্ত টিকে থেকেছি, দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি এজন্য হাজার শুকরিয়া।  

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বজলুর রশিদ খান বলেন, বাহাজ উদ্দিন ফকিরের এ ত্যাগ সত্যি বিরল ও অনুসরণ যোগ্য। তার অবদান বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে।  

তিনি আরো বলেন, পরিচালনা পর্ষদ তার প্রতি খুশি হয়ে আরো দুই বছরের জন্য বিদ্যালয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাকে আজ (বুধবার) বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৩ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৭
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।