প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করে তা পরীক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট থাকেন। আর এত সংখ্যক মানুষের সম্পৃক্ততায় প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকিও অনেক বেশি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে প্রশ্ন প্রণয়নের চিন্তা করলেও সীমাবদ্ধতার কারণে তা এখনো পারছে না। তবে এবার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সে দিকেই এগোতে চায় সরকার।
প্রচলিত পদ্ধতিতে বোর্ডের কাজ শেষে বিজি প্রেসে প্রশ্ন ছাপা হয় এবং সেখান থেকেই উপজেলা পর্যায়ে চলে যায় বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন। প্রশ্ন প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দুর্বলতার কথাও শোনা গিয়েছিল তার মুখে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রশ্নপত্র প্র্রণয়ন করেন নির্বাচিত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা, যাদের বলা হয় ‘সেটার’। কোন যোগাযোগ ছাড়া তারা সাত দিন বোর্ডে থেকে প্রশ্ন মডারেটরের হাতে দেন। মডারেটররা প্রশ্ন মডারেট করে সিলগালা করে দিয়ে যান। সেই প্রশ্ন বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সভায় লটারি করা হয়। যেমন- ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এবং ‘ঘ’।
এসব প্রশ্ন সেট থেকে বিজি প্রেসের ক্ষমতা আছে দুই সেট প্রশ্ন ছাপানোর। শুধুমাত্র খামের উপর লটারি করে নির্ধারণ করা হয় কোন দুই সেট ছাপানো হবে। এ পর্যায় পর্যন্ত বোর্ডের চেয়ারম্যানেরও প্রশ্ন দেখার সুযোগ নেই।
পরীক্ষার অন্তত দুই মাস আগে বিজি প্রেসে যাওয়ার পরে সেখানে ছাপানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন দেখতে পারেন। চাহিদা অনুযায়ী সেখানে প্যাকেট হয়ে বিশেষ নিরাপত্তায় প্রশ্ন যায় জেলায়, জেলা থেকে থানায়। সাধারণত জেলায় রাষ্ট্রীয় ট্রেজারিতে থাকে সদরের প্রশ্ন, অন্যগুলো থানায় থাকে। যেখানে থানা থাকে না সেখানে সরকারি ব্যাংকের ভোল্টে সংরক্ষণ করা হয় প্রশ্ন।
সংরক্ষণ করা প্রশ্ন পুলিশি পাহারায় কেন্দ্র সচিব নিয়ে যান। কিন্তু অনেক সময় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ।
এই অভিযোগের পর এ বছর ট্রেজারি বা নিরাপত্তা হেফাজত হতে প্রশ্ন গ্রহণ ও কেন্দ্রে পৌঁছানোর সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর কেন্দ্রের সংখ্যা অধিক থাকার কারণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে একজন নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে নিয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
শিক্ষা সচিব জানান, চার হাজার ৩১২টি কেন্দ্রের একটিতে সর্টিং পর্যন্ত আটজন এবং আরো প্রায় ৫০০ উপকেন্দ্র বা ভেন্যু আছে। এখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের সংশ্লিষ্টতা। পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে কোনোমতে সম্ভব না, কোনো কালই হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণ আছে। উপজেলা পর্যায়েও যত ক্যাডার অফিসার এবং অন্যান্য অফিসার আছে তাদের সবাইকে নিয়ে পরীক্ষা নিতে হয়।
পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিটের অধিক সময়ের পূর্বে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট যাতে না খোলা হয় তা নিশ্চিত করা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার উপস্থিতিতে কেন্দ্রে বিধি মোতাবেক প্যাকেট খোলার নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, অন্য সময়ে আগের দিন প্রশ্নফাঁস হতো। সে ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী বোর্ড চেয়ারম্যান যদি মনে করেন প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তবে তিনি ট্রেজারিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে প্যাকেট খুলে দেখবেন। যদি দেখেন যে, ফাঁস হয়েছে তাহলে ওই পরীক্ষা সেই প্রশ্নে আর হবে না। তখন হয় বাতিল বা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে না- এর নিশ্চয়তা আমার বা কারো পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়; গত বৃহস্পতিবার একথাই বলেছিলেন শিক্ষা সচিব সোহরাব।
তিনি বলেছিলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট। এরমধ্যে দুই একজন অপকর্ম করলে প্রত্যেকের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই ৩০ হাজার মানুষকে মনিটর করার উপায় নেই। আর বাস্তবতা হচ্ছে, এই ৩০ হাজার মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তাদের উপরই বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপুরি পুরো দেশকেই নির্ভর করতে হয়।
সোহরাব হোসাইন বলেন, আগে ২২৮ জন লোক বিজি প্রেসে প্রশ্ন দেখতে পেতেন। এটা কমিয়ে ১৮ জনে এসেছে। যারা যুক্ত তাদের নাম ঠিকানা বিভিন্ন বাহিনীর কাছে থাকে। সেখান থেকে প্রশ্নফাঁস কঠিন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৮
এমআইএইচ/এমজেএফ