ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

মীর কাশেমের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জবির টেন্ডার ‘বে-আইনি’

ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০২২
মীর কাশেমের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জবির টেন্ডার ‘বে-আইনি’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, (জবি) : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) নতুন ক্যাম্পাসের চারদিকে লেক খনন করবে কর্তৃপক্ষ। তাই গত ১৫ জুন ২৭ কোটি টাকায় টেন্ডার চুক্তি বাস্তবায়ন করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

চুক্তি হয় একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া মীর কাসেম আলীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউআইএডিএল’র সঙ্গে। কিন্তু এ চুক্তি বে-আইনি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টজনরা।

এ ব্যাপারে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জেভি) নামে অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আপিল দাখিল করে। বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষে শুনানিও হয়। গত ২০ জুলাই শুনানির রায় হয়। এতে খাল খননের চুক্তি বে-আইনি ও চরম প্রশাসনিক অদক্ষতার পরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আর্থিক জরিমানাসহ টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিকে (টেক) প্রশাসনিকভাবে অদক্ষ বলে আখ্যা দেওয়া হয় শুনানিতে।

টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক. ড কামালউদ্দিন আহমদ (কমিটির চেয়ারম্যান), সদস্য সচিব প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শাহাদাত হোসেন, উপ-প্রধান প্রকল্প পরিচালক লায়লা ইয়াসমিন সদস্য ও প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী রিভিউয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এটি ভেঙে দক্ষ জনবল নিয়ে নতুন করে কমিটি পুনর্গঠন করতে উপাচার্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসাইনের বিরুদ্ধে মীর কাশেমের প্রতিষ্ঠান ইউআইএডিএলকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

আদেশের অনুলিপি থেকে জানা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) লেক খননকাজের এ টেন্ডারের বিরুদ্ধে আপিল করে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জেভি) নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে গত ৫ জুলাই আপিল শুনানি হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রকল্প পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন, প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারি ও উপপ্রধান প্রকৌশলী আমিরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

শুনানিকালে আপিলকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক খননকাজের টেন্ডারের জন্য ৬টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সমদর দাখিল করে। সমদর দাখিল হলে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস’র বিধান মতে সমদরের ক্ষেত্রে ‘ইভালুয়েশন ম্যাট্রিক্স’ ব্যবহার করে দরপত্র (টেন্ডার) মূল্যায়নের বিধান আছে।

এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের অধীনে কোনো দরপত্রদাতার চলমান কাজ থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ৬০ নম্বর প্রাপ্ত হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প পরিচালকের অধীনে নতুন ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানের ৬০ নম্বর বেশি পেয়ে টেন্ডার পাওয়ার কথা। তবে প্রতিষ্ঠানকে এই নম্বর না দিয়ে উল্টো অযোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে।

এই বক্তব্যের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়, ৬০ নম্বর প্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি বিধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানের পার্টনার ‘কিংডম বিল্ডারস লিমিটেড’ নতুন ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজটি এ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তাদের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৫ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাম্প্রতিক সময়ে ইস্যুকৃত নির্দেশনা অনুসারে, এমন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া সম্ভব নয় বলে অভিযোগকারীর দরপত্রটিকে ‘নন রেসপন্সিভ’ গণ্য করা হয়। এছাড়া মাটির কাজের (আর্থ ওয়ার্ক) ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির স্বল্প অভিজ্ঞতা রয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়, চলমান কাজ সমাপ্ত করতে নানা প্রতিকূলতার সৃষ্টি হলে কর্তৃপক্ষ বরাবর বিভিন্ন সময়ে পত্র দিয়ে প্রতিকার চাওয়া হয়। তবে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। এছাড়া তাদের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় মর্মে কর্তৃপক্ষ কখনও সতর্ক বা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। চলমান কাজ শেষ না করলে তাদের নতুন কাজ দেওয়া যাবে না; এরূপ কোনো শর্তও টেন্ডার ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হয়নি।

এই বক্তব্যের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বলা হয়, চলমান কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে লিখিতভাবে কোনো সতর্ক বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুনানিতে স্বীকার করে।

উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রিভিউ প্যানেলের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সীমানা প্রাচীরের কাজের যে গাফিলতির কথা বলা হচ্ছে তার কোনো লিখিত অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে করেনি। তাই এই অভিযোগ ধোপে টেকে না।

এছাড়া পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর ৯৮(২) বিধিতে বলা আছে, দরপত্র দলিলে উল্লিখিত মূল্যায়নের নির্ণায়কসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো নির্ণায়কের ভিত্তিতে কোনো দরপত্র মূল্যায়ন করা যাবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মৌখিক বক্তব্য অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী চলমান কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নতুন কাজ প্রদানে বিধিনিষেধ যদি আরোপিত হয়, তবে বিষয়টিও টেন্ডার ডকুমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ ছিল।

কিন্তু তা উল্লেখ না করায় এই নির্ণায়কের ভিত্তিতে দরপত্র মূল্যায়ন করার কোনো আইনগত সুযোগ ছিল না। দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এর মূল্যায়ন কমিটি চরম পেশাগত অদক্ষতা প্রদর্শন করেছে। বেআইনিভাবে অভিযোগকারীর দরপত্রটিকে ‘নন রেস্পন্সিভ’ গণ্য করেছে। অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ প্রদানে সুপারিশ না করে ইউআইএডিএলকে সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া গত ৮ জুন তারিখে ইউআইএডিএলকে ‘নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড’ ইস্যু করলে অভিযোগকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই তারিখেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর ও ইজিপিতে প্রকল্প পরিচালক বরাবর অভিযোগ দাখিল করে। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগেও অভিযোগ দাখিল করে। তবে অভিযোগ বিবেচনায় না নিয়ে ১৫ জুন ইউআইএডিএল’র সঙ্গে লেক খননের জন্য চুক্তি সম্পাদন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ৫৯(২) বিধি ভঙ্গ করেছে।

বিধিতে বলা হয়, দরপত্র নিয়ে কোনো অভিযোগ বা আপিল বিবেচনাধীন থাকলে উক্ত অভিযোগ বা আপিলের উপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত চুক্তি সম্পাদনের নোটিশ জারি করা যাবে না। কিন্তু, বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আইন ও বিধির প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বে-আইনিভাবে অভিযোগকারীর সঙ্গে অবিচার করে ইউআইএডিএল’র সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

তবে চুক্তি সম্পাদন হয়ে যাওয়ার কারণে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রতিকার দেওয়ার সুযোগ নেই বলেও উল্লেখ করেন সিপিটিইউ রিভিউ প্যানেল-১।

উভয়পক্ষকে অভিযোগকৃত বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া অভিযোগকারীকে ১৫ দিনের মধ্যে ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে চুক্তি সম্পাদনে আইন ও বিধিবিধান অনুসরণে অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা চরম প্রশাসনিক অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে জ্ঞান সম্পন্ন কর্মকর্তার সমন্বয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি পুনর্গঠনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এ রায়ের বিষয়ে আপিলকারী ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণেই বলা হয়েছে অনিয়ম করে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। চুক্তি হয়ে যাওয়ায় আপিল খারিজ হয়ে গেছে। আমরা এ রায় নিয়ে আইনগত প্রক্রিয়ায় উপরের স্তরে পদক্ষেপ নেব।

এ বিষয়ে নতুন ক্যাম্পাস প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সাহাদাত হোসেন বলেন, রায়ের আদেশে আপিল খারিজ হয়েছে। রায়ে আর যা বলা হয়েছে সেভাবে সামনে বাস্তবায়ন করা হবে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারি বলেন, রায়ে কিছু পর্যেবক্ষণ দিয়েছে ঠিক। তবে আপিল খারিজের আদেশই আসল বিষয়। রায়ের বিষয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।

এ বিষয়ে টেক কমিটির চেয়ারম্যান ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করলেও পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময় : ১৬২০ ঘণ্টা, ৪ আগস্ট, ২০২২
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad