ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ লিটনের!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩১ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৩
প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ লিটনের!

রাজশাহী: হাত গুণে আর মাত্র আট দিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচন। ২ জুন প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরামহীন প্রচারণা চলছে।

১৯ জুন মধ্যরাতে থামবে ১৮ দিনের এই নির্বাচনী রণতরী। তাই এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচারণা এবং ভোটার ও ভোটের হিসাব-নিকেশ।  

আর নির্বাচনে ঠিক আগের সপ্তাহে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভোট বয়কটের পর অনেকটা নাটকীয় মোড় নিতে চলেছে রাসিক নির্বাচন। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় এমনিতেই কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই রাসিক নির্বাচনে। এরপরও দেশের তিনটি রাজনৈতিক দলের মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনী কাঠামোটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনে হচ্ছিল। কিন্তু একটি দল শেষ দফার সিটি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণার মুহূর্তেই যেন সমস্ত পট পরিবর্তন ঘটে গেল। বলা হচ্ছে- অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন এর মধ্য দিয়ে অনেকটাই প্রতিদ্বন্দ্বীহীন হয়ে পড়ল। তাই এই প্রতিদ্বন্দ্বীহনতাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজশাহীর হেভিওয়েট নেতা খায়রুজ্জামান লিটনের জন্য।

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই রাসিক নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। রাসিকের রাজস্ব খাতে প্রায় শতকোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রাসিকের দায়িত্ব নেন লিটন। ২১ মে রাসিকের রাজস্ব খাতের তহবিলে প্রায় ৪০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রেখে পদত্যাগ করেন তিনি।

এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে লিটন প্রথমবারের মতো রাসিক মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি রাজশাহী মহানগর যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের কাছে পরাজিত হন। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনে তিনি ফের মেয়র হন।  

এরপর রাজশাহী মহানগর পায় নতুন মাত্রা। গেল পাঁচ বছরের উন্নয়নে রাজশাহী অভূত এক ঐশ্বর্য লাভ করেছে। সারা দেশেই পেয়েছে নানান উপাধি ও নতুন পরিচিত। এই সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাজশাহীর দ্যুতি ছড়িয়েছে প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও। সম্প্রতিকালে যারাই রাজশাহী এসেছেন; মুগ্ধ হয়েছেন। করেছেন পাল্টে যাওয়া এই শহরের ভূয়সী প্রশংসাও।

বলা হচ্ছে, এ উন্নয়নেই নির্বাচনী বৈতরণী পার করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন। সেজন্য আরও দুইজন মনোনয়ন চাইলেও শেষ পর্যন্ত নৌকার বৈঠা তুলে দেওয়া হয় তার হাতেই। আর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অনেকটাই নির্ভার ছিলেন নৌকার মাঝি লিটন। বিগত সিটি ও সংসদ নির্বাচনের পর রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নানান কারণে দূরত্ব বেড়েছিল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ১৪ দলের অন্যান্য নেতাদের। কিন্তু সরকারের শেষ সময়ের এই নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিভেদ ও ভুল বোঝাবুঝির ইতি টেনে প্রকাশ্যেই একাট্টা হওয়ার ঘোষণা দেন ১৪ দল নেতারা। ছোট্ট পরিসরে হলেও এখন পর্যন্ত নিজ নিজ অবস্থান থেকে ১৪ দলের প্রার্থী লিটনের পক্ষে তারাও বিভিন্নভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এত কিছুর পরও রাসিক নির্বাচন নিয়ে প্রকৃত অর্থেই নির্ভার হতে পারছেন না নৌকার মেয়রপ্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় একদিকে আগে থেকেই এই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বলছিল একটি পক্ষ। এরপরও দেশের এতগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাকের পার্টির তিন মেয়ের প্রার্থী নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসে নির্বাচনী কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখেন।

তবে রাসিক নির্বাচনের শুরু থেকেই তাদের প্রাণহীন প্রচার-প্রচারণা নিয়ে নগরজুড়ে নানান ধরনের গল্প ডালপালা মেলেছে। সেই গল্পের কফিনে যেন শেষ পেরেক ঠুকে দিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার ঠিক আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে দলটি।

বয়কটের সিদ্ধান্ত দলটির শীর্ষ নেতার হলেও রাজশাহীতে সোমবার (১২ জুন) সন্ধ্যায় এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন রাজশাহীতে থাকা হাত পাখার মেয়রপ্রার্থী মাওলানা মুরশীদ আলম ফারুকী।  

তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন সিইসি। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু কেমন ফিল্ড করেছেন সেটি আজ সবাই দেখেছে। রাজশাহীতে আমাদের পোস্টার, ফেস্টুন কেটে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ করেছি, কোনো লাভ হয়নি। আগামীতে কেমন নির্বাচন হবে, সেটি দেখলাম আজ। আমরা মনে করি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। সেজন্য এ নির্বাচন বয়কট করলাম।

ওই প্রার্থী এমনও বলেন যে, ইভিএম মেশিনে ভূত-পেত্নী দেখা গেছে। বরিশালের পর একই ঘটনা ঘটেছে খুলনায়ও। যদিও সিইসি বলেছিলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিন্তু আমরা দেখেছি খুলনা ও বরিশাল নির্বাচনে হাতপাখার ওপরে যখন টাচ করা করা হচ্ছে তখন ভোট যাচ্ছে নৌকাতে। আজ প্রকাশ পেয়েছে ইভিএমএর ওপরে ভূত-পেত্নী আছে। তাই এমন ফলাফল গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

রাসিকের মেয়র পদে চার প্রার্থীর মধ্যে এখন বাকি থাকলেন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন (নৌকা), জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপন (লাঙ্গল) ও জাকের পার্টির লতিফ আনোয়ার (গোলাপফুল)।  

এখন পর্যন্ত যারা রাজশাহীর অধিবাসী এবং যারা বাইরে থেকে আসছেন তারা সবাই কমবেশি দেখেছেন যে, নগর প্রচারণায় নৌকার প্রার্থী ছাড়া কোথাও কোনো প্রার্থীর তেমন প্রচারণা নেই। এখনও পোস্টার, ফেস্টুন, মাইকিং ও ব্যানারসহ অন্যান্য প্রচার সামগ্রী কোনো প্রার্থীরই তেমনভাবে চোখে পড়ছে না। পুরো দিনের মধ্যে কিছু প্রচারপত্র বিলি ও বিকেলে একটি নির্বাচনী মিছিল দিয়েই অনেকে প্রচারণার কাজ সারছেন। পরিস্থিতি অনেকটা এমন যেন কোনো ‘নিয়ম রক্ষার’ নির্বাচন চলছে রাজশাহীতে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন তাই যেটুকু না করলেই নয়; সেটুকুই করছেন। তাদের বিপরীতে শুরু থেকে একাই রাজশাহীর নির্বাচনী মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নৌকার প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন।

রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মেয়রপ্রার্থী লিটনের নির্বাচনী প্রচার কমিটির অন্যতম সমন্বায়ক আহসানুল হক পিন্টু বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৬টি নির্বাচনী সভা, সমাবেশ ও গণসংযোগ করেছেন তারা। নির্বাচনের আগে তা শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে। তাদের লক্ষ্য সবাইকে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করা। যেন সবাই কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যেন ভোট দেওয়া থেকে বিরত না থাকেন। কেন্দ্রে যেন স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে।

এদিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়। সেখানে ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। ১২ জুন খুলনা ও বরিশালে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বরিশালে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং খুলনায় ৪৫ শতাংশ। এই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছিল। কিন্তু সর্বশেষ দফায় ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এই দলটি থাকছে না। তাই বিএনপির সমর্থকদের পাশাপাশি এখন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কর্মী-সর্থকরাও ভোট থেকে বিরত থাকবেন। তাই শেষ পর্যন্ত কারও পক্ষে জয় এলেও ভোটদানের হার অন্যান্য সিটির চেয়ে কম হতে পারে। তাই শেষ মুহূর্তে এসে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এমন নির্বাচনই এখন নৌকার শক্তিশালী প্রার্থী লিটনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহিত করতে মানুষের বাড়ি-বাড়ি যাচ্ছেন।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর পরও সেখানে ভোটের হার ছিল ৫০ শতাংশের কম। খুলনার শক্তিশালী প্রার্থীরও প্রায় একই অবস্থা। তাই কী হতে যাচ্ছে রাজশাহীতে সেই আলোচনাই এখন নতুন করে আলোচনার রসদ যোগাচ্ছে সবার মুখে। এক সময়ের জামায়াত-বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীতে শক্তিশালী কোনো প্রার্থী জয় পেলেও তা যেন কম ভোটের জয় না হয় সেজন্য রাত-দিন এক করে দেওয়া হচ্ছে।

নৌকার প্রার্থী লিটন ও তার বিশাল কর্মী সমর্থকরা প্রচারণার এই শেষ দিনগুলোতে শহরের অলিগলি চষে বেড়াচ্ছেন। এবার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

মেয়রপ্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমাদের লক্ষ্য ৭০ শতাংশ ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। সেটা আমরা করতে পারলে সব ক্ষেত্রে সফল হবো। যেমন বিএনপিকে মোকাবিলা করা হল, প্রার্থীকেও জয়যুক্ত করা হলো। এরপর আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারবো শত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে বিপুল সংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করেছে। তখন রাজশাহী উন্নয়নে বেশি করে বরাদ্দ চাইতে পারবো। অতএব, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৩
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।