ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

হত্যা মামলার তদন্ত চলমান, হলফনামায় ‘অব্যাহতি’ লিখলেন প্রার্থী

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪২ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০২৪
হত্যা মামলার তদন্ত চলমান, হলফনামায় ‘অব্যাহতি’ লিখলেন প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বুলবুল আহমেদ চৌধুরীর (ইনসেটে) বিরুদ্ধে। ফাইল ছবি

ঢাকা: কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী বুলবুল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে তার হলফনামায় একাধিক অসত্য তথ্য দেওয়ার অভিযোগ মিলেছে। তিনি জন্মতারিখ নিয়ে জালিয়াতি ও ফৌজদারি মামলার তদন্ত চলমান থাকলেও তা থেকে ‘অব্যাহতি পেয়েছেন’ বলে দাবি করেছেন হলফনামায়।

এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর অভিযোগও দিয়েছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আনিসুর রহমান।

তার অভিযোগ ও হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে বুলবুল চৌধুরীর জন্মতারিখ ১৯৮১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। জমা দেওয়া নথিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৯৫ সালে সামাজিক বিজ্ঞানে তৃতীয় বিভাগে ডিগ্রি পাস করেছেন। দুই কাগজের হিসাবে, বুলবুল চৌধুরী মাত্র ১৪ বছর বয়সে ডিগ্রি পাস করেছেন। সাধারণত ১৬-১৭ বছর বয়সের নিচে এসএসসিই পাস করা যায় না।

বুলবুল আহমেদ চৌধুরীর এসএসসির সনদ ও এ পরীক্ষার নিবন্ধনে দেখা যায়, তার প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৯৭৫ সালের ৬ মার্চ। এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধনে উল্লিখিত জন্মতারিখ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত জন্মতারিখের মধ্যে পাঁচ বছর আট মাস ব্যবধান।

বুলবুল চৌধুরী তার হলফনামায় ফৌজদারি মামলা সম্পর্কেও অসত্য তথ্য লিখেছেন। তিনি ২০২২ সালে দৌলতপুরের আমদহের এনামুল হকের ছেলে আব্দুস সালাম হত্যা মামলার তিন নম্বর আসামি। কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে মামলাটি চলমান। মামলার নম্বর জিআর ২৫৩/২২। তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, ‘এফআইআরে তথ্যে মিল না পাওয়ায় মামলা হতে তদন্তেই অব্যাহতি’।  

অথচ নথি অনুযায়ী, সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল মামলাটির শুনানি হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তাধীন মামলাটির প্রতিবেদন দেওয়ার তারিখ রয়েছে আগামী ৪ জুলাই।

মামলার বাদী আব্দুস সালামের বাবা এনামুল হক বাংলানিউজকে বলেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার ছেলেকে ২০২২ সালে মাস্টার পাড়ায় হত্যা করা হয়। সেখানকার সিসি ক্যামেরায় তার প্রমাণ আছে, যা কোর্টে জমা আছে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছেও আছে। সালামের স্ত্রী তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বুলবুল চৌধুরীর হলফনামায় অসত্য তথ্য দেওয়ার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে হত্যাকাণ্ডের শিকার আব্দুস সালামের পরিবারকে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে অপরিচিত আইডি থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তার বাবা এনামুল হক। তিনি বলেন, তারা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে। মামলা করা হয়েছে, মামলা চলছে। বাবা হিসাবে আমি এটা করছি। কিন্তু নির্বাচনের পরে দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হলফনামায় উল্লিখিত অসত্য তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বুলবুল আহমেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, যা সঠিক হলফনামায় জমা দিয়েছি। জন্ম তারিখের বিষয়টি হলো প্রিন্টে ভুল হয়েছে।  

মামলা সংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার সর্বশেষ মামলার যে কাগজ, নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সেটা জমা দিয়েছি।  যা সঠিক তেমনই জমা দিয়েছি। আপনার কাছে কী তথ্য আছে, যা ইচ্ছা তা লিখেন।

প্রার্থীর হলফনামায় এমন অসঙ্গতির বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু আনছার মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত মনোনয়নপত্র দাখিলের বিরুদ্ধে দাবি-আপত্তি আছে কি না বা কোনো অভিযোগ আছে কি না তা দেখা হয়। আমার জানা মতে, ওই সময় কোনো অভিযোগ তোলা হয়নি। আপিলের সময়ের মধ্যেও কেউ অভিযোগ করেনি। আর বয়সের ব্যাপারে ভোটার তালিকার কোনো তথ্যের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তবে হলফনামার ব্যাপারে সত্য-অসত্যের একটি ব্যাপার আছে, আপনি যেটা বলছেন—এসব বিষয় নিয়ে যখন প্রশ্ন করার কথা তখন কেউ প্রশ্ন করেনি।

মুহাম্মদ আবু আনছার বলেন, যাচাই-বাছাইকালে বিষয়টি চোখে না পড়ার একটি কারণ হতে পারে, প্রার্থীর বয়স ২৫ বছর নির্ধারিত থাকা। বাছাইয়ের সময় সাধারণত নজরে থাকে ২৫ বছরের নিচে হচ্ছে কি না সেটা। বয়সের ক্ষেত্রে প্রার্থীর উচিত ছিল এসএসসির সনদ দেখে এনআইডি করা। তাহলে এটাই সঠিক হতো।

এ বিষয় কথা হয় জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ সঙ্গেও। তিনি মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের যে বিধিমালা আছে, সে মোতাবেক হলফনামায় এসএসসি পাসের সনদ বা নিবন্ধনের কোনো কপি দেওয়া হয় না বা বিধিমালায় নেই বলে চাওয়াও হয়নি।

একজন প্রার্থী ১৫ বছরেরও কম সময়ে ডিগ্রি পাস করেছেন, হলফনামায় উল্লেখ ও সংযুক্ত করা সেই ডিগ্রি পাসের সনদ দেখে প্রশ্ন তোলা যেত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষাগত সনদের শেষ সনদের কথা বলা হয়েছে। হলফনামায় সেটাই সংযুক্ত করা হয়েছে। সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা বয়স ও এনআইডিতে উল্লেখ করা বয়স যদি ভিন্ন হয় এবং কেউ অভিযোগ করে, আমরা সেটা তদন্ত করে দেখবো। তারপর বলা যাবে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এবং নির্বাচনের আগেই তা দেখবো।  

প্রার্থীর মামলা চলমান, আগামী ৪ জুলাই শুনানির তারিখ রয়েছে; তারপরও হলফনামায় ‘মামলা থেকে অব্যাহতি’র কথা উল্লেখ করার বিষয়ে আপনার দপ্তরে কোনো তথ্য ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, থানা থেকে যে তথ্য পেয়েছি তার ভিত্তিতে আমরা আবেদন জমা নিয়েছি।  

থানা থেকে কি এই প্রার্থী সম্পর্কে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে যে, তদন্তে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি, প্রার্থীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিস আওয়ারে কাগজপত্র দেখে বলা যাবে।

মামলাটির বিষয়ে কথা হয় বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, এটি জিআর মামলা, জটিল মামলা। তদন্ত চলমান। আদালত থেকে প্রতিমাসেই তারিখ দেয়। তদন্ত শেষ করতে সময় লাগবে। মামলার তদন্ত কোনো আসামিকে খালাস বা অভিযোগ প্রমাণের পর্যায়েই পৌঁছায়নি।

হলফনামায় দেওয়া তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ
এ বিষয়ে কথা হয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি জানান, উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় নির্বাচন; এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে। এখানে এলাকার উন্নয়নের ব্যাপার যেমন রয়েছে, তেমনি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের ব্যাপার রয়েছে। তাই বিষয়টি যেমন আইনি, তেমনি নৈতিকতারও। এ বিষয়ে স্পষ্ট আইন রয়েছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হলফনামায় দেওয়া তথ্য ভুল বা অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। এমনকি নির্বাচনের পর নির্বাচিত হলে নির্বাচিত পদ থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন তাকে অপসারণও করতে পারে।

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ২১ এপ্রিল। তা যাচাই-বাছাই হয় ২৩ এপ্রিল। ২৬ এপ্রিল ছিল আপিলের তারিখ। প্রত্যাহারের তারিখ ছিল ৩০ এপ্রিল। আর প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ মে। আগামী ২১ মে এ উপজেলায় অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০২৪
জেডএ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।