মেয়র পদে না হলেও মহানগর মেতেছে কাউন্সিলর নির্বাচনে। ঘনিয়ে আসা ভোট উৎসব ছড়াচ্ছে উত্তাপ।
ময়মনসিংহ: ঠাটা রোদের তেজ কমেনি তখনও। প্রচণ্ড দাবদাহের ভেতরেও ঠিকই ঝড় উঠেছে চায়ের কাপে। চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ভোটের আলাপ।
কথাবার্তায় প্রাধান্য পাচ্ছে মসিক-এর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন।
‘কারে ভোট দিমু অহনও (এখনও) ঠিক করি নাই। ব্যক্তি দেইখ্যাই (দেখে) ভোট পড়বো’ স্থানীয় ইট ব্যবসায়ী ইসলাম মিয়ার (৪৫) স্বগতোক্তি।
তবে তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সমবয়সী মো. মোখলেছ মিয়া জবাব দিলেন আরো কঠিন ভাষায়। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
পুরোপুরি আঞ্চলিকতায় জমিয়ে তুললেন আড্ডা। বলে চলছেন, ‘সিদ্ধান্ত লওয়া (নেওয়া) শেষ। সব প্রার্থীরাই বাড়িঘরে ভোট চাইবার আইতাছে (আসছে)। আচরণেও বেজায় বালা (ভালো)। তবে গাঙ (নদী) পার অইলে (হলে) বেঈমানি করবো না এমন প্রার্থীরেই বাইচ্চা (বাছাই) রাখছি। ভোটের আবহাওয়া (পরিবেশ) ঠিক থাকলে যোগ্য প্রার্থীই বাইর (বের) অওয়া আইবো (হবে)। ’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার উজান ভাড়েরা, মধ্যবাড়েরা, ভাটি বাড়েরা ও শিকারিকান্দার আংশিক নিয়ে গঠিত ২৬ নম্বর ওয়ার্ড।
সম্প্রতি এক বিকেলে সরেজমিনে গেলে এভাবেই ভোটের বিশ্লেষণ করছিলেন প্রান্তিক এসব ভোটারেরা।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত আলাপ চলছে স্থানীয় চায়ের দোকানগুলোতে। এ আড্ডার যেন শেষ নেই!
এ ওয়ার্ডে ১৭ জন প্রার্থী সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে সব ছাপিয়ে মূল লড়াই জমে উঠেছে রেডিও প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. গোলাম মোস্তফা ও ঠেলাগাড়ী প্রতীকের মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। উচ্চ শিক্ষিত মোস্তফা সাবেক ইউনিয়ন পরিষদেরও (ইউপি) সদস্যও। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) শফিক কালো টাকার মাধ্যমে ভোটের মাঠকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন বলে বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ তার।
অবশ্য এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী শফিকুল।
ময়মনসিংহ পৌরসভার আগে ওয়ার্ড ছিলো ২১ টি। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরো ১২ টি ওয়ার্ড। আগামী ৫ মে মহানগর নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ওয়ার্ডগুলোও ভোটের আমেজে একাকার।
মহানগরে উন্নীত হলেও এসব ওয়ার্ড এখনও গ্রামই রয়ে গেছে। এখনও এগুলোকে গ্রাম বা ইউনিয়ন বললে ভুল হবে না। সামান্য নাগরিক সেবা তো দূরের কথা উল্টো পাহাড়সম সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে তাদের।
নতুন ১২ টি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, ইউনিয়ন থেকে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডে উন্নীত হলেও সব রকমের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। প্রতিটি ওয়ার্ডই ধুঁকছে ড্রেনেজ সমস্যায়।
বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতাই যেন তাদের নিয়তি! সংস্কারবিহীন ভাঙাচুরা রাস্তাঘাটে দুর্ভোগ অন্তহীন। নেই মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। সমস্যার শিকলবন্দি এই দশা থেকে মুক্তি চান এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।
ওয়ার্ডগুলোর ভোটারদের ভাবনায় প্রাধান্য পাচ্ছে জনপ্রত্যাশার নানা দিক। তারা বলেছেন, নিজের এলাকায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন, দুঃস্থদের বিপদে এগিয়ে আসা, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোরতা এবং ন্যায় বিচার করতে পারবেন এমন প্রার্থীকেই ভোটে প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা।
এসবের পাশাপাশি আবার প্রার্থীদের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন ভোটারেরা। তবে নির্বাচনের পরপরই এসব নাগরিক সমস্যার সমাধান করতে নানামুখী প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
জানা গেছে, আগের ২১ টি ওয়ার্ডের তুলনায় নতুন ওয়ার্ডগুলোর প্রত্যেকটিতে সাধারণ ও সংরক্ষিত দু’টি পদেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যেমন রয়েছেন সাধারণ মানুষ, তেমনি সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও কাউন্সিলর হতে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন।
তাদের প্রচারণার স্টাইলেও এনেছেন বৈচিত্র্য। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পটভূমিকে শহরে রূপান্তরিত করতে সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধিত্ব করতে চান তারা।
স্থানীয় সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের উত্তর দাপুনিয়ার হাড়গুজি পাড়, উজান বাড়েরা, বাদেকল্পা ও আকুয়া ইউনিয়নের গন্দ্রপাসহ মোট ৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড।
এ ওয়ার্ডে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মাধ্যমিক শিক্ষ প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে নানা অভিযোগ ওয়ার্ডবাসীর।
পথ চলতে গিয়ে স্থানীয় গন্দ্রপা বাইপাস মোড়ে দেখা হলো স্থানীয় কিশমত বন্দের পাড়া এলাকার গৃহবধূ লাইলী আক্তারের (৪০) সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলে গেলেন নিজেদের ‘দুঃখগাঁথা’।
তাদের এলাকায় শুধু নেই নেই এমনটি জানিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, ‘আমগর এলাকায় ভালা (ভাল) রাস্তা নাই। পানিতে আর্সেনিক। পোলাপানের লেইগ্যা (সন্তানদের জন্য) নাই বালা (ভালো) স্কুল। ’
কেমন প্রার্থীকে ভোট দিবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সৎ, সাহসী ও যোগ্যতা দেইখ্যাই (দেখে) ভোট দিমু (দিবো)। গরিবের পাশে খাড়াইবো (দাঁড়াবে), ন্যায়ের পথে চলবো (চলবে) এবং মাদকের বিরুদ্ধে লড়বো এমন প্রার্থীই ভোটে জিতবো। কেউ ঠ্যাহাইতে (ঠেকাতে) পারবো না। ’
লাইলীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই এলাকার বাসিন্দা ও অভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটার নিপা আক্তার (৩৫) বলেন, ‘ভোট লইবার (নেওয়ার) সময় অনেকেই মধুর কতা (কথা) কয় (বলে)। ভোট শেষ অইলে (হলে) চিনেই না। এমন প্রার্থীর টাইম নাই। গরিব দেইখ্যা (দেখে) হেলা করলে মাঠ যাইবো গা। ’
সদর উপজেলার আকুয়া দক্ষিণপাড়া ও মোড়লপাড়া নিয়ে গঠিত ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে পা রাখতেই দেখা হলো এই ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী মো. শামছুল হক লিটনের (ঠেলাগাড়ী) সঙ্গে।
তার অবস্থা এমন যেন, দম ছাড়ারও সময় নেই। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘এ এলাকায় আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। এখানকার সাধারণ মানুষের দুঃখ-সুখ ও অভাব অভিযোগের কথা আমার জানা। আমি অতীতে ইউপি সদস্য ছিলাম। ওই সময়েই তাদেরকে সেবা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ’
‘এবার নির্বাচিত হতে পারলে এ ওয়ার্ডকে মডেল ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে তুলবো। শুধু কথার কথা না, সব সমস্যার কার্যকর সমাধানই করবো,’ যোগ করেন তিনি।
** মসিক নির্বাচন: নতুনের চ্যালেঞ্জে পুরাতনরা
** মসিক নির্বাচন: কাউন্সিলর পদে তীব্র লড়াই
** মসিক নির্বাচন: নতুন মহানগরে ভোটের উচ্ছ্বাস
** মসিক নির্বাচন: জনপ্রতিনিধির দৌড়ে ২৯ জন গৃহিণী
বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১৯
এমএএএম/এমএ