ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত হচ্ছে রাজশাহীতে

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০২৩
চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত হচ্ছে রাজশাহীতে ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভে রাখা প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন

রাজশাহী: প্রায় দুই দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্র কিংবা ওয়েব সিরিজ নির্মাণে, বার বারই উঠে আসছে রাজশাহীর নাম। এখানকার তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের চিন্তা, চেতনা ও মননশীলতা দিয়ে সৃষ্টি করছেন অসাধারণ সব চরিত্র।

মানুষের বিনোদনের খোরাক মেটাচ্ছেন চমৎকার সব গল্প, অভিনয় ও নির্মাণশৈলী দিয়ে। তাই কুড়াচ্ছেন প্রশংসাও।

এবার তার সাথে ছন্দ মেলাতে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সেই শহরে চালু হতে যাচ্ছে, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর।  

যার নাম দেওয়া হয়েছে- ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’। শত বছরের পুরোনো ম্যাজিক লণ্ঠন, ভিডিও ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরা, রিল, রেডিও, ক্যাসেটপ্লেয়ার, ভিডিওপ্লেয়ার, হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র, সেতার ও প্রজেক্টর রয়েছে এখানে।

সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি নভেম্বরেই দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে ব্যতিক্রমী এই সংগ্রহশালা। স্থানীয় চলচ্চিত্র সংগঠক ও নির্মাতা আহসান কবীর লিটন পুরোপুরি ব্যক্তি উদ্যোগেই শুরু করেছেন এই সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার কাজ। রাষ্ট্রীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা আপাতত না থাকলেও সঙ্গে পেয়েছেন সমমনা সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র কর্মীদের সহায়তা।

অর্থাৎ ঋত্বিক ঘটকের শহর রাজশাহীতে শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে- দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর বা ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ।  

ঋত্বিক কুমার ঘটক; যিনি ঋত্বিক ঘটক হিসেবেই সুখ্যাতি ছড়িয়েছিলেন চলচ্চিত্র জগতে। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর জন্ম নেওয়া ঋত্বিক ঘটক বিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। তার জন্ম অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়া এলাকায়। আর দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে রাজশাহী শহরের শিরোইল এলাকায়।

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় ৯০০ মিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রয়েছে শিরোইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। তার পাশ ঘেঁষেই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে দেশের প্রথম ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ। বাংলাদেশের দুর্লভ ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে ধরা হয়- রাজশাহীর প্রাচীন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরকে। এটি দেশের প্রথম ‘জাদুঘর’।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত এই জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে প্রাচীন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন। বলা হয়ে থাকে এটি কেবল বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। তাই তার সাথে মিল রেখে দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর চালু হতে যাচ্ছে এখানেই।

রাজশাহীর শিরোইল এলাকায় গিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভে ঢুকতেই, দেখা মিলল আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ‘বায়োস্কোপ’ এর। গ্রামীণ জনপদে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের অন্য মাধ্যম ছিল এই বায়োস্কোপ। কালের বিবর্তনে বায়োস্কোপ আজ হারিয়ে গেলেও স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে তা সংরক্ষিত করা হয়েছে এই চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক জাদুঘরে। তার পাশেই রয়েছে শত বছরের পুরানো একটি লন্ঠন প্রজেক্টর।

একটা সময় ছিল- যখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমই ছিল এই ম্যাজিক লন্ঠন। তখনকার সময় এটিই ছিল চলচ্চিত্র সরঞ্জামের এক আশ্চর্য প্রতীক।  

যতদূর জানা যায়, ১৯১০ সালে ম্যাজিক লণ্ঠনই ছিল চলচ্চিত্রের প্রাণ। কালের বির্বতনে হারিয়ে গেছে এই অনুষঙ্গ। তাই হারিয়ে যাওয়া এমন জিনিসপত্র সংগ্রহে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন এর প্রতিষ্ঠাতা।

এছাড়াও জাদুঘরে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন জেনারেশনের ৪৮টি রেডিও। বিভিন্ন কোম্পানির ১০টি ক্যাসেটপ্লেয়ার। এখানে রয়েছে সবচেয়ে পুরোনো ৫০ দশকের ভাল্ব রেডিও। ৬০টির মত টেলিফোন রয়েছে যেগুলো ৭০ এবং ৮০ দশকের। রুমের শেলফে থরে-থরে সাজানো রয়েছে ওলেমপিয়া কোম্পানির সেই পুরোনো টাইপ রাইটার। আর এই টাইপ রাইটার দিয়েই দেশে টাইপ রাইটার যুগ সূচনা হয়েছিল।  

রয়েছে বিভিন্ন দেশের সংগ্রহ করা ধাতব মুদ্রা ও কাগজের নোট। তিনটি সাদাকালো টেলিভিশন। নামিদামি ব্রান্ডের পুরোনো ১৭টি স্টিল ক্যামেরা। আর ক্যামেরাগুলো বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের। বিভিন্ন স্টুডিওতে ছবি তোলার কাজে ব্যবহৃত হতো এসব ক্যামেরা। রয়েছে সিনেমার শুটিংয়ের কাজে ব্যবহৃত ১টি ভিডিও ক্যামেরাও।  

শুধু তাই নয়, এই ১৫ বছর আগেও সিনেমা দেখার জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল ডিজিটাল প্রজেক্টর, সিডি, ডিভিডি। যেগুলো আগে মানুষ বাড়িতেও ভাড়া নিয়ে গিয়ে দেখতেন।

এদিকে সাংস্কৃতিক গ্যালারিতে রাখা হয়েছে- বেশ কিছু বাঁশের বাঁশি। দেওয়ালে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ৪টি কর্নেটের বাঁশি। রয়েছে হারমনি, সেতার, বিলুপ্তের পথে থাকা শারদ শঙ্খ, নাগরার ঢোলক, ঢোল, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, ডুগডুগি, বিন বাঁশি, ঝুনঝুনি এবং অতি সুপরিচিত সানাই।  

যেগুলো এক সময় দেশবিদেশের চলচ্চিত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। শত বছরের পুরোনো এমন আরও সব সরঞ্জাম দিয়েই তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’।

এই আর্কাইভ ঘুরে দেখা গেছে- এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন রকমের দুর্লভ সব সরঞ্জাম এবং পুরোনো আমলের যন্ত্রপাতির সমাহার ঘটেছে। এসব কখনও কিনেছেন, কখনও পেয়েছেন সম্পর্কের খাতিরে।  

আবার কখনও বা বিদেশে গিয়ে কিনে আনতে হয়েছে। মূলত দেশবিদেশের আনাচেকানাচে ঘুরে এসব সংগ্রহ করেছেন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান কবীর লিটন। যদিও দুর্লভ সরঞ্জামগুলো এখনও সংগ্রহ অবস্থায় রয়েছে।  

তাই ‘ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ’ এখনও দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। তবে নভেম্বরের শুরুতে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্তের কথা ভাবছেন এর পরিচালক লিটন।

আহসান কবীর লিটন বলেন, মূলত চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ব্যবহৃত দুর্লভ ক্যামেরা, ম্যাজিক লণ্ঠন, সাদা কালো টেলিভিশন, শারদ শঙ্খ, নাগরার ঢোলক, ঢোল, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, ডুগি-ডুগডুগি সংগ্রহ করে আপাতত তিনটি রুম নিয়ে তারা রাজশাহীতে এই আর্কাইভটির কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। এছাড়া তার এখানে দেড় হাজারেরও বেশি দুর্লভ বইও রয়েছে। তাদের টার্গেট, আরও ১০ হাজার বইয়ের। এজন্য কাজও করছেন।

কিন্তু সংগ্রহ বেশি হওয়ায়, আপাতত অনেক সরঞ্জামই আর্কাইভের প্রর্দশনী রাখতে পারছেন না। এরপরও প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম সাজানো হয়েছে। এটি খুলে দেওয়ার আগে সেগুলোর নাম-পরিচয়ের বর্ণনা থাকবে। আর্কাইভের কাজ শেষ হলে প্রতিটি সরঞ্জামেরই দেওয়া হবে আলাদা পরিচয়।

চলচ্চিত্র নির্মাতা আহসান কবীর লিটন বলেন, একটা সময় ছিল যখন মানুষ সিডি বা ডিভিডিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন সিনেমা দেখতেন। এর আগে ১৯০০ সালের দিকে ম্যাজিক লণ্ঠনের প্রচলন ছিল। অথচ এগুলো বর্তমান যুব সমাজের কাছে এখন কাল্পনিক। এমন ঐতিহ্যবাহী সব জিনিসপত্র এখানে এসে দেখতে পেলে দর্শনার্থীরা দারুণ উচ্ছ্বসিত হবেন। আর তাদের জন্যই এত সব আয়োজন। এগুলো দেখে সবাই একটা ধারণা পাবেন কালের বিবর্তনে চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তন হলো, ছোঁয়া লাগলো আধুনিকতার। নির্মাণ কাজ শেষ হলে নভেম্বরেই সংগ্রহশালাটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ভাবছেন, এই উদ্যোক্তা। আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই সংগ্রহশালার পরিধি আরও বাড়তে চান তিনি।  

এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন না হলেও রাজশাহীর শিরোইল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এই ব্যতিক্রমী জাদুঘর দর্শন করতে পারছেন আগ্রহীরা। সপ্তাহের প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকছে এই ব্যতিক্রমী আর্কাইভ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২৩
এসএস/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।