কলকাতা থেকে : উড়ে না গিয়ে সড়ক পথে কলকাতায় যারা যেতে চান তাদের জন্য কয়েক ছত্র। বেনাপোল গিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওপারে সিএনজিতে চড়ুন।
এই ভিড়ের মধ্যেও দেড়-পৌনে দুই ঘণ্টার যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে চলছে তাস খেলা। ভাবছেন যেখানে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই, সেখানে তাস খেলা যায় কীভাবে? হাতকেই টুল বানিয়ে চলছে সময় কাটানো। বিভূতিভূষণ হল্ট, চাঁদ পাড়া, সংহতি, ঠাকুর নগর- এমন কিছু জংশন পেরিয়ে দমদম এলে ভিড়ভাট্টা একটু কমে। দমদম থেকে পার্ক স্ট্রিট যাওয়ার মেট্রোতে চড়লে পেরোতে হয় আটটি স্টেশন- গিরিশ পার্ক, সুতানটি শোভাবাজার, মহাত্মা গান্ধী রোড, চাঁদনী চক, সেন্ট্রাল, এসপ্লানেড প্রভৃতি।
পার্ক স্ট্রিট লাগোয়া মার্কুইস স্ট্রিট ও মির্জা গালিব স্ট্রিট মূলত মধ্যবিত্তদের এলাকা। এখানকার আবাসিক হোটেলগুলোও এই শ্রেণীর পর্যটকদের সাধ্যের সীমায়। ৫০০-৮০০ রুপিতেই মিলবে মাথা গোঁজার ঠাঁই। আদতে তা শুধু কোনোরকম রাত্রিযাপনের মতো। ঠ্যালা রিকশা লক্ষণীয়। মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) এখানে এসে ঘুরে ঘুরে এসব তথ্য মিললো। পথের পাশে লুচি-সবজি বিক্রি চলছে। মিষ্টিবিলাসের সুযোগও আছে। সব মিলিয়ে সোরগোল অবস্থা। ঠিক বিপরীত চিত্র নজরুল মঞ্চে, সাউদার্ন এভিনিউতে। আলিশান ব্যাপার-স্যাপার চারপাশে। গাড়ি, বাস, অফিস, রেস্তোরাঁ- সবকিছুতে। এখানকার আমেজটাও সুনসান।
বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) কাকভোর অবধি নজরুল মঞ্চেই কাটলো। হাঁটতে হাঁটতে এলাম রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে। এক চা-দোকানি কেটলিতে জল গরম করছেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শোনা যাচ্ছিলো পাখির কিচির-মিচির শব্দ। এ যেন তাদেরও বিজয় উল্লাস! একপাশে চোখে পড়লো অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘আরশি নগর’ ছবির লম্বা পোস্টার। তাতে দেব আর ঋতিকার মুখ। রোমিও-জুলিয়েটের চিরন্তন প্রেমকাহিনী অবলম্বনে বানানো এটা। পোস্টারটার সামনে দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হলুদ ট্যাক্সি নয়তো ছোট আকারে ট্রাক চলে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে গাছের পাতাগুলো চিকচিক করছে। মনে হয় যেন, বৃষ্টি ছুঁয়ে গেছে তাদের! খানিক পর ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভলো। বেলা হচ্ছে।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরটা কেমন ছিলো? সেটা সব মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিতে ভাস্বর। বাংলাদেশ আলাদা মানচিত্র পাওয়ার দিনটি চির অম্লান হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়ও। এই ডিসেম্বরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে ভারত।
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এটা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। নিজেদেরকে এই গৌরবের অংশ মনে করেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় উৎসব উদযাপন করে কলকাতা। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ভোরেই ফোর্ট উইলিয়ামের ফটকের সামনে বিজয় স্মারকে মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মরণে এই বিজয় স্মারক তৈরি হয়েছে। এবার থেকে এই স্মারকে যোগ করা হয়েছে অনির্বাণ দীপশিখা।
এ ছাড়া কলকাতার তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা নাচ, গান, কবিতায় উদযাপন করছেন মহান বিজয় দিবস। আর বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতায় নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে তো চলছেই পাঁচদিনের ‘বাংলাদেশ বিজয় উৎসব’। দ্বিতীয় দিনের আয়োজন শুরু হবে দুপুর ২টায় (স্থানীয় সময়)। ততক্ষণ পর্যন্ত রাত জেগে বিজয়ের কাকভোর দেখার আনন্দ বয়ে বেড়ানো যাক।
** নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে এক টুকরো বাংলাদেশ
**কলকাতায় শুরু হলো বাংলাদেশ বিজয় উৎসব
** ‘মমতার অন্তরের একদিকে পশ্চিমবঙ্গ অন্যদিকে বাংলাদেশ’
কলকাতা সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
জেএইচ/আরআই