নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকনের বহুমাত্রিক কাজ নিয়ে বিশ্লেষণ চলতে পারে। কিছু কিংবদন্তি ঘটনা রয়েছে তাকে ঘিরে।
নায়ক-নায়িকা নয়, পোস্টারে একজন পরিচালকের নাম দেখে প্রেক্ষাগৃহে হুমড়ি খেতেন দর্শক। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তারকাখ্যাতি পাওয়া যায়- তিনি রেখে গেছেন সেই প্রমাণও। কালজয়ী অনেক ছবির কারিগর শহীদুল ইসলাম খোকন। তিন বছর রোগে ভুগে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল চিরমুক্তির দেশে চলে গেছেন। ১৯৫৭ সালের ১৫ মে জন্মেছিলেন কৃতি এই সন্তান।
খোকন মানেই হিট, মৌলিক গল্পের কারিগর!
শুধু প্রেম-ভালোবাসা নয়। রম্য গল্প নিয়েও প্রশংসিত ছবি করেছেন খোকন। দেশপ্রেমসহ চলমান সামাজিক প্রেক্ষাপটও খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরতেন তিনি। দর্শকরা সিনেমা হলে গিয়ে কখনও বঞ্চিত হতেন না বিনোদন থেকে। পরিপূর্ণ বিনোদন নিয়েই ফিরতেন দর্শকশ্রেণী। তাই শহীদুল ইসলাম খোকনের ছবি মানেই ছিলো হিট।
ছবির জন্য নিবেদিত প্রাণ এই পরিচালক এমন অনেক কিছুই করেছেন যা এ দেশে আগে কেউ দেখাতে পারেননি। উড়ন্ত বিমানে লাইভ অ্যাকশন দৃশ্য শুট করেছিলেন তিনি। ছবিটির নাম ছিল ‘বিপ্লব’। এ ছবির জন্য রুবেল মাথার চুল ফেলেছিলেন। ছবিটির একটি দৃশ্যে রুবেল জ্যান্ত একটি ইঁদুরে কামড় দেন।
এখন মৌলিক গল্পের বড় অভাব। কিন্তু খোকনের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে এই দৈন্যতা দেখা যায় না। প্রতিটি গল্পই ছিলো মৌলিক। কখনও তার বিরুদ্ধে ওঠেনি নকলের অভিযোগ। প্রসঙ্গত এসে যায় এটিএম শামসুজ্জামানের একটি মন্তব্য, ‘খোকনের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে। স্বল্প বাজেটে কীভাবে দুঃসাহসিক ছবি করা যায় এবং সেটা জনপ্রিয় করা যায়- খোকন সেটা খুব ভালোভাবে করতে পারতেন। ’
ছফা, এটিএম এবং খোকন
প্রখ্যাত লেখক আহমদ ছফা তখন বেঁচে আছেন। এটিএম শামসুজ্জামানের বন্ধু ছিলেন তিনি। শহীদুল ইসলাম খোকনের মাথায় ঘুরছে ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’। এটাকে চলচ্চিত্রে রূপ দেবেন তিনি। কী করা যায়! খোকন দ্বারস্থ হলেন এটিএম শামসুজ্জামানের। গুণী এই অভিনেতা বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন লেখক বন্ধুকে। এটিএম শামসুজ্জামান নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, খোকন তার উপন্যাসের ক্ষতি করবেন না। প্রথিতযশা এই দুই মানুষের সম্মান রেখেছিলেন খোকন। এ ব্যাপারে এটিএম শামসুজ্জামান বলেছেন, “খোকন ছফার কাছে আমার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। ‘বাঙলা’ ছবিটি আমার বিশেষ পছন্দের। এমন পরিচালক আবার কবে আসবেন কে জানে!”
খোকনস্পর্শে ধন্য তারা
নেতিবাচক চরিত্রে হুমায়ূন ফরীদির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিলো খোকনের। তার পরিচালনায় ‘সন্ত্রাস’ সুপারহিট হওয়ার পর দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ব্যস্ততম খলনায়কের আসনে বসে ফরীদি। গুণী এই অভিনেতা খোকনকে বুঝতে পারতেন। যে কারণে তার জন্য প্রযোজকও বনেছিলেন ফরীদি। কিন্তু মন্দ কপাল ছিলো দু’জনেরই। ‘পালাবি কোথায়’ ব্যবসাসফল হয়নি।
তরুণ ভিলেন হিসেবে ড্যানি সিডাক প্রতিষ্ঠা পান নব্বই দশকে। তার আবিস্কারকও খোকন। নজরুল নামে খোকনের একজন সহকারী ছিলেন। পরে তিনি নায়ক হন। পর্দানাম আলেকজান্ডার বো। ‘লম্পট’, ‘চারিদিকে শত্রু’র পর খোকনের ‘ম্যাডাম ফুলি’তে একক নায়ক হয়েছিলেন আলেক।
সিমলাকে সবাই চেনেন ‘ম্যাডাম ফুলি’র মাধ্যমে। তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনেক খোকনই। খোকনের হাত ধরেই প্রথম ছবিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সিমলা।
‘ভন্ড’ ছবির মাধ্যমে আরেক নায়িকা নিয়ে আসেন খোকন। তার নাম তামান্না। সুন্দরী এই নায়িকা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে না এলেও দেশীয় ছবির আঙিনায় ঠিকভাবেই নাম লিখিয়েছেন।
মার্শাল আর্ট জনপ্রিয় কেনো
মাসুদ পারভেজ তথা সোহেল রানার প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন খোকন। এভাবে কেটেছে দশ বছর। আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি ওস্তাদের আশীর্বাদ নিয়ে নিজে ছবি পরিচালনা শুরু করেন। দূর্ভাগ্য, তার প্রথম ছবি ‘পদ্মগোখরা’ ব্যবসা করতে পারেনি। এমনকি দ্বিতীয় ছবিও ব্যর্থ হয়। হতাশ শিষ্যকে তারপরও কাছে টেনে নেন সোহেল রানা। এবার নিজের ভাই রুবেলকে নায়ক হিসেবে প্রমোট করানোর জন্য খোকনকে নির্বাচন করেন তিনি। এখানেই তৈরি হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সবচেয়ে সফল পরিচালক-নায়ক জুটির। পরে প্রায় পনের বছরের বেশি সময় এই খোকন-রুবেল জুটি চলচ্চিত্র শাসন করেন। তাদের ছবির সংখ্যা ২৯। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো প্রকৃতপক্ষে মার্শাল আর্ট জানা একজন নিখুঁত নায়ক পেলো চলচ্চিত্রাঙ্গন। খোকনের ছবিতেই মার্শাল আর্ট পেয়েছে ভিন্নমাত্রা ও জনপ্রিয়তা।
দারুণ দুঃসাহস!
প্রতিটি ছবিতেই নিজস্বতা রেখেছেন খোকন। তার মতো সাহসী নির্মাতা খুব কমই দেখা যায়। প্রযোজক নয়, নায়িকা নয়, গল্পের প্রয়োজনীয়তা রেখে সব করতেন তিনি। খোকন তার ছবিটিতে কী দেখাতে চান সে ব্যাপারে পরিস্কার ছিলেন। ককটেল ছবি বানানোর পক্ষে ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে চলে আসে ‘ঘাতক’ ছবির কথা। এতে সরাসরি গোলাম আজমকে তুলে ধরেছেন রাখডাকহীনভাবে। হুমায়ূন ফরীদি গোলামের চরিত্রটিও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ছবিটিতে গোলাম আজমের মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের অপকীর্তি তুলে ধরেছেন খোকন। এটা একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং ও সাহসী কাজ বলেই স্বীকৃত। কথিত আছে, সিনেমাটি হলে চলার সময় পুলিশ নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকতো। ‘ঘাতক’-এর পাশাপাশি ‘সন্ত্রাস’, ‘কমান্ডার’ ছবিগুলোও দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মসলাদার ছবির বাজার মাত করা এ নির্মাতা তৈরি করেছেন ‘পালাবি কোথায়’ ও ‘বাঙলা’র মতো ভিন্ন মেজাজের ছবি। এ-ও তো কম সাহসের ব্যাপার নয়!
খোকনের ভিন্নমাত্রার প্রতিবাদ
‘ইহা একটি সিনেমার পোস্টার’-এই একটি বাক্য দিয়ে সিনেমার অশ্লীলতার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন। অশ্লীল সিনেমার যুগে নিজের নতুন ছবি ‘যোদ্ধা’র প্রচারে এভাবেই মাঠে নেমেছিলেন খোকন। গুণী এই পরিচালক অনেক বিষয়ে অটুট থাকতেন নিজের বিশ্বাসে। যেমন তার সময়ে রেকর্ড পরিমাণ সম্মানী হাঁকাতেন তিনি। এমনকি নায়ক-নায়িকার চেয়েও বেশি ছিলো তার পারিশ্রমিক। খোকন প্রযোজকদের বলতেন, ‘…যে শিল্পী আমার চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাবেন, তিনি পরিচালক হিসেবে আমাকে মূল্য দেবেন না। আমার কথা শুনবেন না। আর এর ফল ভালো হবে না। ফিল্ম ইজ অ্যাবসল্যুটলি ডিরেক্টরস মিডিয়া। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৭
এসও