লাকী ভাইয়ের নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে আমার, বিশেষত তার শেষ দিনগুলোয়। প্রায় দেড় বছর আগে তার অসুস্থতা ধরা পড়ার পর থেকে অনেকটা পথ একসাথে হেঁটেছি আমরা।
গান গাওয়ার ক্ষেত্রে গানের কথা কিংবা সুরের প্রশ্নে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন লাকি ভাই। নিয়াজ মোহাম্মদের মতো গুণী শিল্পীও ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না’ গানের রেকর্ডিংয়ের এক পর্যায়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘দোস্ত, তোর পায়ে পড়ি, আমারে মাফ কইরা দেও! আমি এইটুকুই পারি। আর পারবো না। ’সামিনা, ফাহমিদা আপারাও গান গাইতে গেলে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতেন লাকী ভাইয়ের সামনে। নিজের গানের সামান্যতম বিকৃতি মেনে নিতেন না কখনো তিনি।
লাকি ভাইয়ের শেষ কিছু চাওয়া ছিলো। সেগুলো নিয়েই কথা বলবো এখানে।
ধন্যবাদ না দিতে পারার বেদনা
লাকী ভাইয়ের হৃদয়-মন অভিভূত করে দিয়েছিলো বাংলার মানুষের ভালোবাসা। প্রথম যখন মানুষ তার অসুখের খবর জানলো এবং যেভাবে তারা প্রতিক্রিয়া দেখালো, তার কাছে এটা মনে হচ্ছিলো এক বিস্ময়। দেশে এবং দেশের বাইরে যে তার এতো ভক্ত, এতো মানুষ তাকে ভালোবাসে, অভিভূত হয়ে তিনি বারবার বলতেন, আমাকে এতো মানুষ ভালোবাসে! তার অসুখের খবরে চিকিৎসা সহায়তার উদ্দেশে কনসার্ট আয়োজন শুরু হলো প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর কানাডা ও ইউরোপে। এসব ঘটনা জানার পর তার মনের ভেতর ছটফটানি, প্রবল আলোড়ন তৈরি হলো। আমাকে বলতেন, ‘একটু সুস্থ হলেই আমি নিজে ওদের কাছে যাবো। তুমি আমার ভিসা লাগানোর ব্যবস্থা করো। ওরা আমাকে এতো ভালোবাসে, আমিও ওদের মাঝে হাজির হবো। ওদের গান শোনাবো। প্রথমে নিউইয়র্ক যাবো, সেখান থেকে কানাডায়। রকেটদের ওখানে যাবো। আশিকুজ্জামান টুলু সেখানে আছে। ওরাওতো বড় কনসার্ট করেছে? ওখান থেকে ইউরোপ আসবো। লন্ডনে, ওখানেও তো তিতাসরা শো করেছে, না? জুয়েলরা? আচ্ছা, ফ্রান্সেও কী ওরা কোনো শো করেছে? ফ্রান্স থেকেও যোগাযোগ করেছে। আচ্ছা কোন দেশটা কাছে? কোন দেশ থেকে শুরু করলে ভালো হয়? কীভাবে যাওয়া যায়? আচ্ছা, একটা ওয়ার্ল্ড ট্যুর প্ল্যান করতে হবে। ওরা আমার জন্য করেছে, আমারতো ওদের জন্য কিছু করতে হয়। ’
আমি তার সামনে বসে বসে শুনছি আর ভাবছি, অসুস্থ একটা লোক, বিছানায় শোয়া। উঠতে পারছেন না। অথচ তিনি প্ল্যান করছেন, আমি এটা করবো, আমি এটা করে দিয়ে যাবো। অথচ করতে পারছেন না। সবখানে যেতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নিও আর। এই যে একটা না পারার কষ্ট, ভালোবাসার প্রতিদান দেয়ার আকুতি অথচ দিতে না পারার কষ্ট! ‘আমি কবে যাবো? এই আমার পার্সপোর্ট কোথায় বলতো? তুমি কী ভিসা লাগাইছো, বলতো?’ বারবার বলতেন লাকী ভাই।
একদিন ইউনাইটেড হাসপাতালে বারবার যখন এসব কথা বলছেন তখন রকেট ভাইয়ের ভিডিও ফোন কল, আমি কেবিন থেকে বাইরে এলে জানতে চান, উনার অবস্থা কি? আমি বললাম, একটু আগেই তো দেখলেন শুয়ে আছেন। উনি কী উঠতে পারেন? আমি বললাম, না। উনি কীভাবে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে আসবেন? আমি কেঁদে দিলাম। একজন মানুষ, যতো অসুখই থাক, মনের সবটুকু জোর দিয়ে বলছে, সে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হবে। গান শোনাবে তার প্রিয় মানুষগুলোকে। আমি কীভাবে তাকে বলবো, লাকী ভাই আপনি অনিরাময় রোগে আক্রান্ত। আপনি আর হয়তো কখনও সুস্থ হবেন না। এটাতো আর বলা সম্ভব হয়নি। আমরা তাকে বলেছি, লাকী ভাই, আপনি আর একটু ভালো হয়ে উঠলে আমরা অবশ্যই যাবো।
এ বছরের শুরুর দিকে তানভির শাহিন এলো আমেরিকা থেকে। ওর সঙ্গে কথা বললেন লাকী ভাই। ওর অ্যালবাম প্রকাশনা অনুষ্ঠানে হাজির হলেন। অভিভূত হয়ে গেল তানভির শাহীন। ওর অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন করলেন, যে অ্যালবামে ‘নীল নীল শাড়ি’ গানটা রয়েছে। ওখানে বসেও তিনি তানভিরকে বললেন, ‘আমি আমেরিকা কবে যাচ্ছি? দেখেছো, আমি অতটা অসুস্থ নই, চাইলেই কোথাও যেতে পারবো’।
এটা ছিলো তার একটা আক্ষেপ। ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন মানুষগুলোর কাছে গিয়ে, দিতে পারলেন না। লাকী ভাইয়ের অসুস্থ হওয়ার পর প্রথম এগিয়ে এলেন গীতিকার আসিফ ইকবাল এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিল। এদের তৎপরতা আর উদ্যোগে শিল্পীকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ব্যত্তিগতভাবে বেশকিছু টাকা দিলেন শাকিল ভাই। যদিও নিজের শেষ সম্পত্তিটুকু বিক্রি করে হলেও চিকিৎসা করাবেন তবু কারো কাছ থেকে কোনো সহায়তা নিতে নারাজ ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতার বার্তায় তার সেই জিদ অপসৃত হলো। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা মানেই তো জাতীয় স্বীকৃতি। তিনি বললেন, ‘এইটা আমি নিতে পারি। ’ প্রধানমন্ত্রীর এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আরো অনেক মানুষ জানলো, সেই সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এগিয়ে এলো সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে। তিনি বলছিলেন, ‘আমি থাইল্যান্ড থেকে ফিরে এসে পিএমের সাথে দেখা করবো, তাকে ধন্যবাদ জানাবো। ’ লাকী ভাইও প্রায়ই ভাবতেন, ‘আচ্ছা, পিএম কী আমাকে দেখতে আসবে, একবার? না, হয়তো, সেক্ষেত্রে আমি নিজেই যাবো পিএমের কাছে। তুমি ব্যবস্থা করো। ’
একদিন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ভাই এলেন বিএসএমএমইউতে। কথা প্রসঙ্গে নিজেই বললেন, ‘আমি পিএমের কাছে আপনার ধন্যবাদ পৌঁছে দেবো। টেনশনের কিছু নাই। ’ সর্বশেষ ৩ মে, মঙ্গলবার, জাতীয় সংসদে লাকী ভাইয়ের ওপর শোক প্রস্তাব আনা হলো। খুব খারপ লাগছে আজ, মৃত্যুর আগে ধন্যবাদ জানিয়ে যেতে পারলেন না তাদেরকে, যাদেরকে জানাতে চেয়েছিলেন।
গানটা নষ্ট করো না কিছুতেই!
এরপর লাকী ভাইয়ের গান। তিনি যখন তার গানের কপিরাইট সম্পর্কে জানলেন, এসব গান থেকে এতো… এতো টাকা পাওয়ার কথা ছিলো তার, তখন বললেন, ‘তাহলে, এগুলো কপিরাইট করো। গান গুছাও। সব রেডি করো। ’
সব রেডি করা হলো। এবার আমরা রওনা দিবো কপিরাইট অফিসে। এ সময় একদিন বললেন, ‘টিংকু, এক কাজ করো। কপিরাইট অফিসে দিও না। ওখানে তো লোকজন নানা ধরনের। এটা-সেটা করবে। দেরি করাবে। তাছাড়া কনটেন্ট প্রোভাইডার, প্রোডাকশান ও মোবাইল কোম্পানিগুলো তো সবাই ওদের ধরে ফেলেছে। আমরা বরং এদের কাছে না গিয়ে তারানা হালিমের কাছে যাই। তাকে অনুরোধ করবো যেন সে নিজে এগুলো নজরদারি করে। আমাদের কপিরাইটগুলো করিয়ে এনে দেয়। অনেকগুলো তো আর ফিরেই পাবো না। রেডিওতে আমার সুর করা প্রায় কয়েক হাজার গান আছে, সেগুলো তো আর পাবো না। তোমরা যে লিস্ট করেছো, সেগুলো নিয়ে মুভ করো। অন্তত আমার উত্তরসূরীরা যেন টাকাটা পায়, সেই ব্যবস্থা করো। ’ আমি যখন তাকে বললাম, আপনি থাকবেন না কিন্তু আপনার গানগুলো থেকে আপনার পরিবার প্রতিমাসে রয়্যালটির টাকা পাবে। তখন তার মধ্যে একটা ভরসা তৈরি হলো। বললেন, ‘আচ্ছা আমি অসুস্থ আজ প্রায় দু’বছর অথচ কোথাও থেকে কোনো ইনকাম নেই আমার। ’
লাকী ভাইয়ের বাসা ভাড়া ছাড়া আর কোনো ইনকাম ছিলো না তখন। মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় তার চিকিৎসা চলেছে। বলছিলেন, ‘যখন থাকবো না তখন এ সাহায্য সহযোগিতাও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কী হবে?’ আমি তাকে বললাম, চিন্তা নেই। প্রতিমাসে এসব গান থেকে বেশকিছু টাকা পাবেন। তিনি বললেন, ‘তা কী সম্ভব? শিওর তুমি?’ আমি বললাম, নিশ্চয়ই। যদি মোবাইল কোম্পানিগুলো সাপোর্ট দেয়, রেডিওগুলো সাপোর্ট দেয় তাহলে সম্ভব।
এ সময় আমরা আর একটা কাজ করেছিলাম যে কাজের কারণে বাচ্চাদের নিয়ে টেনশন দূর হয় তার। ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’ তাকে ৪০ লাখ টাকা দেয়। টাকাটা আমরা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিলাম দুই বাচ্চার নামে। ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজটা দেখে আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন লাকী ভাই। ‘এখন আমার দুই বাচ্চার বিয়েশাদি-পড়াশুনা নিয়ে কোনো টেনশন নেই আর। ওরা ওদের মতো করে নিতে পারবে। ’ তারও আগে, আরও এক দফায় দশ-দশ মিলিয়ে বিশ লাখ টাকা ওদের নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছিলাম আমরা।
বিএসএমএমইউ’র সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অধ্যাপক নিজামউদ্দীন আহমেদ স্যারের প্রথম কথাই ছিলো, ওনাকে মানসিক স্বস্তি দেয়া খুব জরুরি যাতে করে পরিবারের ভরণ-পোষন নিয়ে আর টেনশন করতে না হয়। ওনার যেসব সম্পত্তি ছিলো তা আমরা উত্তরসূরীদের নামে হেবা দলিলের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সেখানেও তিনি কোনো ভেদাভেদ করেননি। দুই ছেলে-মেয়েকে সমানভাগে হেবা করে দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া প্যালিয়েটিভ কেয়ারে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শেষ গানের সুর করেছেন যা প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রতি ভালোবাসার উপহার হিসেবে দিয়ে গেছেন।
যাওয়া হয়নি কপিরাইটের কাজেও
লাকী ভাইয়ের সব গুছিয়ে রাখা গানগুলো নিয়ে তার সঙ্গে কপিরাইট সংক্রান্ত কাজে তারানা হালিমের কাছে আর যাওয়া হয়নি। তারানা হালিম তখন সিঙ্গাপুর ছিলেন। এই কপিরাইট না করতে পারাটা ছিলো তার আরেকটা কষ্ট। তার প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত অনেক গান। অনেক গানের রয়্যালটি অন্য কেউ পায়, তিনি পান না।
কপিরাইটের সঙ্গে আরেকটি বিষয়, কে তার কোন গানটি করবেন তার ফয়সালা। উনি বলতেন, এটা রুনাকে দিয়ে, এটা সাবিনাকে দিয়ে, এটা সুবীরকে দিয়ে, কিংবা এটা সামিনাকে দিয়ে গাওয়াবো। যার গলায় যেটি যায়। অথচ আমরা অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। যেমন, প্রাণ গ্রুপ বেশকিছু সময় আগে এসে বলল, ‘আগে যদি জানিতাম’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘এই নীল মনিহার’ গানগুলো লাকী ভাই বললে এগুলো নিয়ে মিউজিক ভিডিও তৈরি করবে। ওরা লাকী ভাইকে কিছু টাকাও দিয়েছিলো। এই প্রজেক্টে লিমন-রেদওয়ান রনি কাজ করেছে। কিন্তু এগুলো লাকী ভাইকে না দেখিয়ে প্রচার করা হলে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। এর মাঝে লিনু বিল্লাহর মতো শিল্পী গাইলেন তার গান। তার বাসায় বারবার গিয়ে গানটি ঠিক করালেন। বারবার তিনি একটি কথা বলেছেন, ‘গাও, কিন্তু গানটাকে নষ্ট করো না। গানের কথা আর সুরের বিচ্যুতি করো না। গানগুলো যেন ঠিকঠাক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। ’ তিনি বলতেন, যখন তিনি থাকবেন না তখন কেউ তার গান করতে চাইলে আগে থেকে যেন তার পরিবারের অনুমতি নিয়ে নেয়। বেসুরো উপস্থাপনায় গানগুলোর অমর্যাদা করা হয়। সেগুলো যেন কেউ না করে।
লাকী ভাই বলতেন, ‘তুমি যদি কঠিন গান তুলতে না পারো তবে গাওয়ার দরকার নাই। সহজ গানটাই করো। ’ তাই আমার অনুরোধ, আপনারা লাইভ করেন বা যাই করেন প্রস্তুতি নিয়ে করেন। অনুমতি নিয়ে করেন। আপনি আপনার গানটাই গান। ওইটাই উৎসর্গ করেন লাকী ভাইকে। প্রোডাকশান কোম্পানিগুলো যেন যথাযথ অনুমতি ছাড়া শুধুমাত্র লাকি ভাইয়েরই না, অন্য কারো করা গান নতুন করে রেকর্ড না করেন, কেননা, রয়্যালটির প্রসঙ্গ রয়েছে।
শেষ সময় পাহাড়ে গিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন লাকী ভাই। থাইল্যান্ডের ডাক্তারই মূলত তাকে বলেছিলেন পাহাড়ের বিশুদ্ধ হাওয়া নিতে। বন্ধুবর রাজা দেবাশীষকে তিনি বলেছিলেন পাহাড়ে গিয়ে থাকার ইচ্ছার কথা। একটা পাহাড় কেনারও শখ ছিলো তার। সেখানে প্রকৃতির মাঝে বসে গান করবেন কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে, এই ছিলো তার বাসনা।
স্বপ্নের কনসার্ট
এবার বলবো লাকী ভাইয়ের মানসে তৈরি হওয়া একটি কনসার্টের কথা।
‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’-এর সূচনা হয়েছে মূলত লাকী ভাইকে ঘিরে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের লাকী ভাইকে সহযোগিতার চিন্তা থেকে তার উদ্যোগেই ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’-এর যাত্রা শুরু। ফাউন্ডেশন হলে কেবল একজন নয়, হাজারও শিল্পী তার বিপদের দিনে সহায়তা পাবে এখান থেকে। এর আগের পরিকল্পনা ছিলো আর্মি স্টেডিয়ামে একটি চ্যারিটি কনসার্ট করার। মেয়রের বাসায় প্রস্তুতি সভায় ফয়সাল সিদ্দিকী বগি, খুরশিদ আলম, হামিন আহমেদ, মাকসুদুল হক, ফোয়াদ নাসের বাবু, জেমস, পার্থ বড়ুয়া, ফাহমিদা নবী, শেখ সাহেদ, মনিরুল ইসলাম টিপু, হাবিব ওয়াহিদ, শারমিন লাকি, আব্দুন নূর তুষার সব মিলিয়ে প্রায় কুড়ি জনের বেশি শিল্পী বসে ঠিক করা হলো কনসার্ট হবে। কেউই কোনো টাকা নেবে না। প্রথম দিনের মিটিংয়ের সে খবর লাকী ভাই শুনেই মহা উত্তেজিত, বললেন, ‘কনসার্ট হবে! তো দেরি কেন? এক কাজ করো। কাগজ আনো। ’ ছক কাটা, পরিকল্পনা শুরু করলেন। প্রথমে কী গাওয়া হবে, কে গাইবে! বললেন, “শুরুটা হোক, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান তো লিখেছি’এটা দিয়ে। ” এর মিউজিক আয়োজন কোথায় হবে, কতো জন ও কি ধরনের মিউজিশিয়ান থাকবে, কে কোথায় বসবে, সব সাজাতে আরম্ভ করলেন কাগজে। দেশের বাইরের বিশালাকার কনসার্টের মতো ভাবতে আরম্ভ করেছেন তিনি। “শোনো, আমি কিন্তু ডিরেকশন দিবো। আচ্ছা, ‘কবিতা পড়ার প্রহর’ ওটার কী হবে, এটা কী একটু সফট গান, এটা কী কনসার্টে থাকতে পারে?” কিন্তু পরের মিটিংয়েই আনিস ভাই বললেন, এতো টাকা খরচ করে কনসার্ট আয়োজনের চেয়ে বরং জরুরি টাকার দরকার, আমি একটু অন্যভাবে টাকাটা জোগাড় করি। কনসার্টটা আমরা পরে করি। সবাই জানি সবচেয়ে জরুরি দরকার টাকা। রাজি হই। শুনে লাকী ভাই হতাশ। কনসার্ট হবে না!
‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’-এর আয়োজনে আমরা চাইনি লাকি ভাইকে নিয়ে যেতে, কেননা, তিনি তখন দারুণ দুর্বল। কিন্তু তার প্রত্যয়ী মনোভাব, ‘আমি যাবো!’ অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারসহ সবধরণের প্রস্তুতি রেখে তাকে নিয়ে গেলাম। অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ঘুমিয়ে গেলেন এক দফা। সময় হলে তাকে তোলা হলো মঞ্চে। মাইক হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি গাইবো। ’ আর শুরু করলেন, ‘আগে যদি জানিতাম’। অভূতপূর্ব এক পরিবেশ তৈরি হলো পুরো মিলনায়তন জুড়ে। অনেকেই উঠে এলো মঞ্চে, বাদবাকি সবাই অশ্রুসজল চোখে গলা মেলালো তার সাথে। প্রথমে একুট বাধো বাধো, তারপর সব ঠিক, বেশ ক’টি গান শোনালেন তিনি।
শেষ দুই-আড়াই বছর তিনি বেঁচেছিলেন মূলত মানুষের ভালোবাসা আর নিজের মনের জোরে। তার শেষ কিছু চাওয়ার কথা বললাম এখানে। এর কিছুটা চাওয়া পূরণ হয়েছে, কিছুটা হয়নি। আবারো অনুরোধ রইলো, লাকি ভাইয়ের গানগুলো কেউ গাইতে চাইলে যেন তার পরিবারের অনুমতি নেন। গানগুলোর বিকৃতিরোধে সবার সচেতনতার আহবান জানাচ্ছি আবারও। শিল্পীর গানের রয়্যালটির ব্যাপারেও আমার যেন সচেতন থাকি।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। লাকি ভাইয়ের নামের সঠিক বানান হলো ‘লাকি আখান্দ’। নামের বানানে ‘আখান্দ’ লিখতে গিয়ে খ-এর আকার না দিলে খুব মন খারাপ হতো তার।
অনুলিখন: মিল্টন মোল্লা
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৭
এসও