আমার গর্বের আরেকটা জায়গগা হলো- বাবা আমার মুক্তিযোদ্ধা, আমি বীর যোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের মেয়ে। আমার জন্মের আগে ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় ডান হাতের তিনটি আঙ্গুল হারিয়েছেন।
প্রথম দিকে নাকি আমার মা’ই খাইয়ে দিতেন কিন্তু বাবা পরনির্ভরশীল থাকতে চাননি। ওই দুই আঙ্গুল দিয়ে খাওয়া, লেখালিখি যাবতীয় সমস্ত কাজ করতেন। বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। বরিশালে শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি সব সময় অগ্রনায়ক ছিলেন। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সব সময়।
আমার বাবা এমন একজন মানুষ, যিনি অন্যকে লজ্জা দিতে বা পেতে দেখলে নিজেই লজ্জা পেতেন। জীবনে কোনোদিন কাউকে ছোট করে কথা বলতে দেখিনি তাকে। বাবাকে কখনো প্রয়োজনের কথা বলতে হয়নি, কেমন করে যেন বুঝে যেতেন সব।
এক দিনের একটা খুবই ছোট্ট ঘটনা মনে পরছে, আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। মায়ের নির্দেশে আমার জুতোগুলো সব বারান্দায় রোদে দেওয়া হয়েছে, এমন সময় বাবা আসলেন জুতোগুলো দেখলেন এবং গুনলেন তারপর আমাকে বললেন ‘চলো মার্কেটে চলো’। আমিতো অবাক, বললাম কেন বাবা? বাবা বললো ‘দুই জোড়া জুতো কম আছে আর দুই জোড়া জুতো হলে তোমার এক ডজন জুতো হবে। ’ অন্য কোনো বাবা হলে দশ জোড়া জুতো দেখে বকাই দিতেন হয়তো। এখনকার সময়ে মানুষের অনেক জুতো-পোষাক থাকে কিন্তু সে সময়ের জন্য এটা খুব সাধারণ বিষয় নয়।
বাবা, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমি যখন পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ি। বাবাই আমাকে চিনিয়েছেন জীবনানন্দ, নজরুল, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুন, আরজ আলী মাতুব্বর’সহ অনেককে। এমনকি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কেও। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র ‘মানুষের মানচিত্র’ কবিতাটি বাবাই আমাকে প্রথম পড়তে দিয়েছিলেন। আড়াই বছর আগে। আমি ভারত যাবো ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘ঈর্ষা’ নাটকের প্রদর্শনী করতে। বাবা ফোন করে বললেন, কাল কখন যাবে তোমরা? বললাম, সকাল ৮ টায়। বাবা বললেন, দিল্লিতে শপিং করবে না? পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছি, ড্রাইভারকে ব্যাংকে পাঠিয়ে টাকাটা তুলে আনো । এটাই ছিলো বাবার সঙ্গে আমার শেষ কথা। পরদিন কলকাতা পৌঁছোবার কিছুক্ষণ পরই ফোন পেলাম বাবা স্ট্রোক করেছেন। সেদিন ছিলো ১৩ ডিসেম্বর। কিন্তু আমার যে নাটকের প্রদর্শনী আছে ১৬, ১৭ ডিসেম্বর ।
দিল্লি গেলাম, প্রথম প্রদর্শনী শুরু করবার আগে জানলাম বাবা স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন কিন্তু আমার তো আরো একটি প্রদর্শনী আছে। দুটো প্রদর্শনী শেষ করে দল রেখেই ১৮ ডিসেম্বর আমি ফিরে এলাম ঢাকায়। এক মাস দুই দিন পেয়েছিলাম বাবাকে। একটু একটু করে বাবা সুস্থ হচ্ছেন, আমরাও আশাবাদি হচ্ছিলাম, বাবার লাইফ সাপোর্ট খোলা হলো। কেবিনে দেওয়া হলো। কথা বলতে পারতেন না। প্রতিদিন হাসপাতালে বাবা কম্পিত হাতে লিখে বোঝাতেন তার কথা।
২১ জানুয়ারি ২০১৮ বাবা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে..! আমার মিষ্টভাষী বাবার কণ্ঠটি আমি আর শুনতে পাই না .....!
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০২০
ওএফবি