ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

গাছ মানুষের চিরদিনের সখা

মুতাসিম বিল্লাহ নাসির | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৮ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১২
গাছ মানুষের চিরদিনের সখা

মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীর প্রধান পার্থক্য হলো মানুষ সংস্কৃতির লালনে, ধারণ ও  চর্চা করে; কিন্তু অন্য কোনো প্রাণী এটা করে না বা করতেও পারে না। মানব সংস্কৃতির বিকাশে মানুষকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে গাছ।

তাকে সুন্দর নির্মল জীবন উপহার দেয় গাছ। পাশাপাশি রোগ থেকে মুক্তি, অভিজাত জীবনযাপনে সুগন্ধি, খাবারে স্বাদ বাড়াতে মশলা তা-ও গাছ থেকেই পাওয়া যায়। ভারতবর্ষও এক সময় বিশ্বে পরিচিত ছিল মশলার দেশ হিসেবে।
 
মানুষের প্রয়োজনেই গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ থেকে শুরু করে বর্তমানের মানুষের জীবনধারা তার সাংস্কৃতিক কাজেকর্মে তার মৌলিক চাহিদা পূরণে গাছ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। প্রাগ-ইতিহাস মানুষের অন্নের চাহিদায় ফলমূল-লতাপাতা থেকে শুরু করে তার শরীর আবৃত করতে গাছের বাকলকে বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, কখনো বা গাছকেই বাসস্থানে পরিণত করা ও চিকিৎসায় গাছ এবং উদ্ভিদ-তরুলতার ব্যবহার আদিম থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত চলমান। গাছের পাতা ও বাকলকে লেখার উপকরণ হিসেবে ব্যবহারও বলতে গেলে ছিল এই সেইদিনকার ঘটনা। গাছের সাথে মানুষের এই সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন আঙ্গিকে।

প্রাক-ইতিহাস যুগে গাছের সাথে মানুষের সম্পর্কঃ আমরা প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখতে পাই প্রাগ-ইতিহাসের মানবরা তাদের বসতিস্থান নির্বাচন করেছে যেখান থেকে সহজে ফলমূল লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করা যায়। তাদের আমরা দেখতে পাই ফলমূল সংগ্রহের জন্য তারা একস্থান থেকে অন্য স্থানে অভিবাসনও করেছে। তারা তাদের খাদ্য প্রস্তুত করতে জীবাশ্ম গাছকে (ফসিল) হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। যার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশেও রয়েছে... বৃহত্তর সিলেটের চাকলাপুঞ্জিতে আমরা জীবাশ্মগাছে তৈরি বেশ কিছু হাতিয়ার পাই।
 
গাছ শুধু মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণই নয় প্রাগ-ইতিহাসের মানুষের হাতিয়ার তৈরিতেও গাছের ফসিলের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। সিলেটের চাকলাপুঞ্জিতে যার সত্যতা আমরা নিরূপণ করতে পারি। মানুষের ব্যক্তিজীবন পেরিয়ে তার ধর্মীয়, সমাজ জীবনে রয়েছে গাছের প্রত্যক্ষ প্রভাব।
 
ধর্মীয় জীবনে গাছের প্রভাবঃ ধর্মীয় জীবনে যেমন আমরা বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন হওয়ার স্থান শনাক্ত করি গাছের নিচে, যশোরের ঝিকরগাছায় বটগাছকে ঘিরে দেখি যুগযুগ ধরে প্রচলিত ঘটকপূজা। তেমনি করে তুলসীগাছ দেখি আমরা হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার আসনে আসীন। ইসলাম ধর্ম প্রয়োজন ব্যাতিরেকে গাছের একটি পাতা ছিঁড়তেও নিষেধ করেছে এবং গাছ লাগাতে উৎসাহিত করেছে।

গ্রামীণ সমাজে গাছঃ আমাদের গ্রামীণ সমাজে হাট-বাজারের নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য ছিল বিশাল কোনো গাছের নিচে হাটবাজার। যাকে সচরাচর আমরা হাটতলা-বটতলা নামে চিহ্নিত করতাম। বটগাছকে ঘিরে হাট-বাজার ছিল প্রায় গ্রামেরই সাধারণ দৃশ্য। গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিত না এমন পথিক খুব কমই ছিল, তুলসী গাছ বটগাছকে নিয়ে আমাদের স্মৃতিতে অনেক ঘটনা গল্প ছোটবেলা থেকেই ধারণ করে আসছি।

গাছের সাথে আমাদের বৈরী সম্পর্কঃ
গাছ আমাদের কোনো ক্ষতি না করে সর্বক্ষেত্রে উপকার করে গেলেও আমরাই গাছের সঙ্গে সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করেছি, নগরায়নের নামে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগাতে সবার আগে হত্যা করেছি গাছকে। যেন পরিকল্পনা করে নগর থেকে গাছকে আলাদা করেছি। কারণে অকারণে হত্যা করেছি গাছ। পূর্বের চেয়ে বর্তমানে যেন গাছ কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে সরাসরি শহীদ মিনার দেখার অজুহাতে তৎকালীন প্রশাসনের উদ্যোগে গাছগুলোকে হত্যা করা হলো। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন মানুষ হিসেবেও গাছের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। ফলে করপোরেট জীবনে, নগরায়নে গাছ যেন ধীরে ধীরে যাদুঘরে সংরক্ষণের উপাদান হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।

নগরায়নের সঙ্গে গাছের সখ্য গড়ে ওঠার বদলে যেনবা নগরায়নের প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে গাছ। গ্রামের দীর্ঘ কালের নীরব সাক্ষী হাট-বাজারে গাছের উপস্থিতিও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। হাটতলার সঙ্গে বটতলার দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কে যেন আজ চিড় ধরেছে। নির্বিচারে বন ধ্বংস করে নিজের প্রয়োজনে গাছ কেটেছি কিন্তু চারা রোপণ করার প্রয়োজন অনুভব করিনি। গাছের সঙ্গে, বনের সঙ্গে মিশে আছে, হাজার প্রজাতির প্রাণীর জীবন। আমাদের প্রতি সেকেন্ডে যার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয় সেই অক্সিজেনও তৈরি করে গাছ। অবহেলার কারণে আজ শুধু বন ধ্বংসের মাধ্যমে গাছের জীবনই ধ্বংস করিনি, তার সাথে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জীবনও ধ্বংসের চূড়ান্ত আয়োজন করেছি। ফলে অনেক প্রাণীর এখন আর দেখাই মিলছে না। পথে পথিকের যেমন ছায়া মিলছে না তেমনি পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়েছে, ছয় ঋতুর বাংলাদেশে থেকে ছয় ঋতুর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যেতে বসেছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে, ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিনিয়ত আমরা। অনাবৃষ্টিতে খেত খামারে ফসল নষ্ট হচ্ছে। গরমের প্রখরতায় অতিষ্ট আজ নগরবাসী।

গাছের সঙ্গে আমাদের অন্যায় আচরণ আজ আমাদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। যেন আমরাই হেসে খেলে নিজেদের মরণফাঁদ তৈরি করছি। তাই আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আজ নগরের সঙ্গে শহরের সঙ্গে গাছের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব তৈরি করতে হবে। পলিসি মেকারদের পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব শহর গড়ার প্রত্যয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। যাতে করে নগরজীবনে শুধু মানুষ নয় তার সাথে গাছ ও প্রাণীকূলের একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়। গাছ লাগানোর পাশাপাশি গাছের সঠিক পরিচর্যার ব্যাপারে সব মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় গাছকে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। অবৈধভাবে গাছ কাটা বন্ধের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও ছাত্র, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার ঢাকা।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।