ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় বায়ু দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি।
গত বছরে ডিসেম্বর মাসে একদিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী। দূষণ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে যতটা বায়ু দূষণ ছিল, তা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ক্যাপসের গবেষণায় দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে বায়ুর গড় মান ছিল ২৮৮। ২০১৬ সালের পর থেকে বায়ুর মান এত খারাপ কখনোই হয়নি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল ১৯৫। গত ৯ বছরে ডিসেম্বরে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২১৯ দশমিক ৫৪। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ মান ৩১ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। আর ২০২৩ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৬ শতাংশেরও বেশি।
বিশ্বের ১২৪ নগরীর মধ্যে সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সকালে ঢাকা বায়ু দূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আইকিউ এয়ারের মান সূচকে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৫২। বায়ুর এ মানকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বায়ু দূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। একিউআই স্কোরে শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কোর মাঝারি, সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১ থেকে ৩০০ স্কোরকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। এ স্কোর ৩০০ ওপরে থাকা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়।
বায়ু দূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ কণার উপস্থিতি। ঢাকার বাতাসে এর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, বায়ু দূষণের ফলে মানুষের বহুবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। বায়ু দূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তনালির ক্ষতি, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অনিয়মিত হার্টের ছন্দ এবং ধমনি শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বিশেষ করে বাতাসে উপস্থিত পিএম ২.৫ কণাগুলোর উচ্চমাত্রা হৃদরোগীদের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষুদ্র কণাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবাহিত হয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং সঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা সৃষ্টি করে।
বায়ু দূষণে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রসঙ্গে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, বায়ু দূষণের ফলে বায়ুতে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকার কথা সেটা থাকে না। দূষিত বায়ুতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান থাকে। দূষিত বাতাসের বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান রক্তনালির লেয়ারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে বায়ু দূষিত থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকিও বেশি থাকে।
তিনি বলেন, হৃৎপিণ্ডের যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন বায়ু দূষিত এবং বিষাক্ত থাকার ফলে সেই পরিমাণ অক্সিজেন হৃৎপিণ্ড পাচ্ছে না। ফলে রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখান থেকে হার্টের ব্লকসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে, ফুসফুস থেকে ঠিকমতো অক্সিজেন সাপ্লাই হচ্ছে না। পাশাপাশি বাতাসে ধুলাবালি এবং বিষাক্ত উপাদান থাকার ফলে ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা এ জাতীয় সমস্যা তৈরি হওয়ার ফলে অক্সিজেনেশন ঠিক মতো হয় না। স্বাভাবিক নির্মল বায়ু থেকে হৃৎপিণ্ড যে পরিমাণ অক্সিজেন পাওয়ার কথা দূষিত বায়ুতে সেই পরিমাণ অক্সিজেন পাচ্ছে না। ফলে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বায়ু দূষণের জন্য পরোক্ষভাবে যে কারণগুলো দায়ী সেগুলোর কারণেও হৃদরোগ হচ্ছে। যেমন- রাজধানীতে অনবরত ভারী যানবাহন চলাচল, বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনের কাজ, গাড়ির উচ্চ শব্দ বা হর্ন, এসবের ফলে মানুষের ওপর সাইকোলজিক্যাল প্রেসার পড়ছে, মানসিক অশান্তি এবং অস্থিরতা বাড়ছে। ফলে মানুষ ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। এসবের প্রভাব পড়ে আবার হৃৎপিণ্ডে। ফলে বায়ু দূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুটি কারণেই হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বায়ু দূষণের ফলে কী পরিমাণ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে- জানতে চাইলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ইদানিং আমরা দেখতে পাচ্ছি বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বায়ু দূষণে যেসব উপাদান আছে, বিশেষ করে পিএম ২.৫ কণা ফুসফুসের ভেতরে প্রবেশ করে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে অক্সিজেনেশন কমে যায়, ধমনির গায়ে চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সেই কারণেই বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি থাকলে ধমনি সরু হয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এখন হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি শীতকালে যখন বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ে, তখন আমাদের হাসপাতালগুলোতে হার্ট অ্যাটাকের রোগীও অনেক বেড়ে যায় এবং মারাও যায় অনেক বেশি। সুতরাং বায়ু দূষণ যেভাবে বেড়েছে সেটা আমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫
আরকেআর/আরবি