রংপুর: রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ইটভাটায় পুড়ছে বনের গাছ। এতে উজাড় হচ্ছে বনভূমি।
জানা গেছে, উত্তরের রংপুর-রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলায় এক হাজার ৯০০টি ইটভাটা রয়েছে। যার মধ্যে এক হাজারের অধিক ইটভাটার কোনো অনুমোদন নেই। এসব ইটভাটা থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সেই সঙ্গে ধোঁয়ায় থাকা ক্ষতিকর কার্বন ডাইঅক্সাইড মানবশরীরে ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে। শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার শিশু-বৃদ্ধসহ লোকজন।
শুধু তাই নয়, ইটভাটাগুলোতে বনের গাছ চোরাপথে বিক্রি করা হচ্ছে। ফসলি জমির টপসয়েল বিক্রি হচ্ছে ইটভাটাগুলোতে। এসব গাছের কাঠ পুড়ছে ইটভাটার আগুনে। উজাড় হচ্ছে বনভূমি। ক্ষতি হচ্ছে ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বরতা।
পরিবেশবাদী ও সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, কয়লাচালিত ইটভাটা দেখানো হলেও গোপনে এসব ইটভাটায় কয়লার পাশাপাশি কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ইটভাটা রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ২০ হাজার একরের বেশি জমি গিলে খেয়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এসব ইটভাটার কারণে কৃষি ফসলের আর্থিক ক্ষতি এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ তথ্য কৃষি উৎপাদনের জন্য মারাত্মক উদ্বেগজনক। বৈধ-অবৈধ এসব ইটভাটায় পরিবেশের ক্ষতি হলেও স্থানীয় প্রশাসন দেখেও যেন দেখছে না।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, অবৈধ ইটভাটা বন্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিএসটিআইয়ের সাম্প্রতিক অভিযান সত্ত্বেও থেমে নেই এসব ইটভাটার উৎপাদন।
কারণ হিসেবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও কাস্টম বিভাগের একটি চক্রের উৎকোচ বাণিজ্যের কারণে এ বিভাগে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটাগুলো থেকে প্রকাশ্যে প্রতিনিয়ত ইট উৎপাদন করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে।
রংপুর ও রাজশাহী (বগুড়া) পরিবেশ অফিস সূত্রে জানা গেছে, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রায় এক হাজার ৯০০ ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে প্রায় এক হাজার ও রাজশাহী বিভাগে প্রায় ৯০০ ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই অনুমোদনহীন। জনবসতি, ফসলি জমি এমনকি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ইটভাটা করা হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো প্রতি বছর প্রায় ১৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা ও কাঠ পুড়ে প্রতি মৌসুমে ৫০০-৬০০ কোটি পিস ইট প্রস্তুত করছে।
জেলা প্রশাসন ইটভাটার লাইসেন্স বা অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু সেজন্য কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তি নেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয়, ইটভাটা স্থাপনের জন্য নির্জন অনাবাদি জমি প্রয়োজন। এছাড়া পাশে বাড়িঘর, বাগান, বনজ ভূমি থাকলে কোনোভাবেই ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এগুলো আইনে আছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই মানা হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক একেএম রফিকুল ইসলাম জানান, ‘রংপুরে বৈধ ইটভাটা মোট ইটভাটার ২২ শতাংশ। বাকিগুলো অবৈধ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। ’
রাজশাহী বিভাগীয় (বগুড়া) উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিভাগে মোট ইটভাটার ৬০ শতাংশই অবৈধ। এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত। ’
একটি ইটভাটায় গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন কয়লা ও এর পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বনের গাছ কেটে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অবৈধ ইটভাটা নিয়ে প্রশাসনের কী উদ্যোগ, জানতে চাইলে রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়েছে। কোনো অবৈধ ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না।
পরিবেশবাদী আইনজীবী মুনির চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, রংপুর- রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলায় কোনো নিয়ম না মেনেই ইটভাটা স্থাপন হচ্ছে। হাইকোর্টের বিধি নিষেধ থাকার পরও স্থানীয় প্রশাসন ও ইটভাটার মালিকরা ইটভাটা স্থাপন করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও আইনের প্রয়োগ না হওয়াটাই দায়ী।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
এইচএ/